Saturday, December 12, 2020

কচুরি পানা

 বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশে একটা আগাছা মুসিবত তৈরি করে। এর আগমন নিয়ে একাধিক গল্প আছে। প্রধান গল্পটা হচ্ছে নারায়নগঞ্জের পাট ব্যাবসায়ী অস্ট্রেলিয়া থেকে এটি বাংলায় এনেছেন। জন্মসূত্রে স্কটিশ অভিবাসী জর্জ মরগান এই আগাছাটির ফুলের সৌন্দর্য আর পাতার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আপনারাও এর ফুল পাতা দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকেন। আগাছাটির নাম কচুরি পানা।


আরেক গল্প হচ্ছে ঊনিশ শতকের শেষে কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে এটি আনা হয়। সেখান থেকে কোন এক পানামুগ্ধ মানুষ সেটিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

তৃতীয় গল্প হচ্ছে এটি আসাম থেকে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে গড়িয়ে ভেসে বাংলায় পড়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই আগাছা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে জার্মান ষড়যন্ত্রও আবিষ্কার হয়েছে। ভারতীয় প্রজাদেরকে দুর্বল করার মাধ্যমে বৃটিশ রাজকে নাজেহাল করার জন্য জার্মানি এই পানা ছড়িয়ে দিয়েছে - এমন তত্ত্বও পাওয়া যায়। সে কারনে লোকেরা এর নাম দিয়েছিল জার্মান পানা। অন্য বর্ণনা হচ্ছে এক বহুজাতিক কম্পানি উদ্দেশ্য প্রণোধিতভাবে বাংলায় কচুরিপানা এনেছে।

কচুরিপানা মোটেও স্বস্তিদায়ক কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা। যদিও আমরা কৃষি শিক্ষা বইয়ে এর সার বিষয়ক উপযোগিতার কথা জেনেছি তবে আমার বন্ধুর সাথে একবার বাজি ধরে হেরে গিয়েছিলাম। চারপাঁচটা বড় কচুরিপানা একসাথ করে সে বলল সে এগুলোর উপর দাঁড়াতে পারবে। হাটুর উপর শরীর ভিজবে না। (আমরা গ্রামের পোলাপান অল্প বয়সেই সাঁতার জানতাম। কাজেই ডুবে মরার ভয় ছিল না।) আমি ভাবলাম গভীর খালের পানি এইকয়টা পানার উপর সে ভাসতে পারবে কিন্ত কোমর পর্যন্ত ভিজবে নিশ্চয়ই। আমাকে অবাক এবং পরাজিত করে সে খালের পানিতে কচুরিপানার উপর দাঁড়ালো। একটাকা বাজিতে আমি হারলাম। সে পাওনা রইল। অবশ্য একটাকা দিতে হয় নাই। কারন সমপরিমাণ বাজিতে আমি জিতে গিয়েছিলাম।

(মাঝ পুকুরে ডুব দিয়ে পুকুরের তলার মাটি উঠানোর বাজি। আমার ভয় হয়েছিল দম বন্ধ হয়ে যায় কিনা, শিকলে টেনে ধরে কিনা। সেসব অতিক্রম করলে তুললাম মাটি। সেকি অনন্য জিত। ওরকম জিত না হলে এতদিন বাঁচতাম কেমন করে! আমার বন্ধু কচুরি পানাকে আমার চেয়ে ভাল চিনত। আমার বন্ধুকে অবশ্য আমি হারিয়ে ফেলেছি। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর, আর অক্ষর আক্রান্ত মানুষের সাথে মিশতে মিশতে আমার ভাষা কিছুটা বদলে যাওয়ায় কিংবা অন্য কোন অনাবিষ্কৃত সাধারণ কারনে আমার বন্ধু আমাকে ”আপনি” বলে অন্যরকম ভাবে বড় হয়ে যাওয়ায়... সুযোগ পেয়ে নিজের কথা আপনাদের শুনিয়ে দিলাম।)

কচুরি পানা ছুটতে পারে অসাধারণ। জলমাতৃক বাংলাদেশে স্রোত আর বাতাসের গতিতে ছুটতে পারার আনন্দ পেয়ে পেয়ে সারা দেশ দখল করল সে। কৃষি জমির এক বিরাট অংশ। নৌকার পালের মত পাতা আর জলের সাথে প্রায় ভাসমান শেকড় আর ওড়ার মত পাতলা শরীর - সবমিলে চেঙ্গিস খানের অশ্বারোহীদের মতন গতি পেল এই মুসিবত।

দেখতে সুন্দর এই আগাছা বাংলার জনপদকে নাজেহাল করে ছাড়ল। ফসলি জমির দখল নিয়ে ফসলের বারোটা বাজিয়ে দিল। ময়মনসিংহ খুলনা কুমিল্লা সহ দেশের বিভিন্ন বিলে ধান চাষ অসম্ভব হলো। বর্ষায় ভেসে ভেসে এসে জমিতে বসলে বর্ষার শেষে কচুরি পানার হাত থেকে জমি উদ্ধার করে চাষ করার শক্তি কই পাবে কৃষক! আর সেই শক্তি পেলেও পরের বর্ষায় আবার দখল নেয়ার জন্য জমিদারদের জমিতে বিনা পয়সার দলবাজ গুন্ডার মত রায়ত থাকত কিছু কচুরি পানা। কৃষক কিছু জমি পরিষ্কার করলেও সব জমি পরিষ্কার করা অসাধ্য। আর সামগ্রিকভাবে তাকে না ঠেকালে আবার দখল করার ক্ষমতা ছিল কচুরি পানার। কারন অন্যান্য গুনের পাশাপাশি সন্তান উৎপাদনের গতি ও ক্ষমতা অন্যান্য ফুল্ল-পত্রশোভিত উদ্ভিদের চেয়ে কচুরিপানার বেশিই ছিল।

বৃটিশ সরকার এই সমস্যাকে বিপ্লবী আন্দোলনের (বৃটিশরা যাদের সন্ত্রাসবাদী বলতো) বিপদের পরে সর্বোচ্চ আপদ হিসেবে বিবেচনা করেছিল। মহামারিতে ম্যালেরিয়া তুল্য এই পানা ম্যালেরিয়া ছড়ানোর মশার জন্য চমৎকার আবাস গড়ে তুলেছিল। শুধু ফসল উৎপাদনে ক্ষতি সীমিত না। ইকোলজির নষ্ট করেছে। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে।

ফসল উৎপাদন কমাতে শুধু মানুষের খাবারেই নয়, গবাদি পশুর খাদ্যেও সংকট তৈরি হয়েছে। ধান চাষ বন্ধ হলে গরুর জন্য খড়বিচালিও বন্ধ। তারপর মহেশের গল্প। আপনারা জানেন সেটা। (এই গানও শুনতে পারেন চাইলে: https://bit.ly/2Hx5Kxn) খাবার হিসেবে গবাদি পশুর জন্য কচুরিপানা ক্ষতিকর। আমার যে বন্ধুর সাথে বাজিতে হেরে গিয়েছিলাম সে বন্ধু গরুকে খাওয়ানোর জন্য কচুরি পানা আনতো। নিয়মিত বা বেশি খাওয়ানো যায় না। গরু দুর্বল হয়ে পড়ে। খুব বিপদে না পড়লে কৃষক গরুকে কচুরি পানা খাওয়াতে রাজি হবেন না। কচুরিপানা খাওয়া গরুরা তখন দুর্বল হয়েছে। কচুরি পানা খেয়ে গরুর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছে। অসুখ বিসুখ হয়েছে। কৃষকের জন্য যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা।

আমাদের দেশ নদীমাতৃক সে কথা আপনারা জানেন। এটা কম বলা হলো। জলমাতৃক বললে আরো ঠিক হয়। (তবে প্লাস্টিক আর বাণিজ্যিক আবর্জনা ফেলে বাংলার মাতা তথা নদীকে হত্যা ও দখলের চেষ্টায় কোন ত্রুটি কিংবা দায়িত্ব অবহেলা বা আন্তরিকতার ঘাটতি কোনটাই দেখায়নি কাণ্ডজ্ঞানে দরিদ্র-ফকিন্নিরা। বাংলা কেমন রাক্ষস জন্ম দেয় যে রাক্ষস নদীও হজম করে ফেলতে পারে। বাংলার রূপ কথায়ও এমন রাক্ষস নাই।) মশকরার চুড়ান্ত হচ্চে জলমাতৃক দেশের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে সড়ক পথকে পলিসিতে রাখা! অবশ্য বৃটিশ বাধ নির্মাণ ব্যবস্থা, রেললাইন তৈরি এই প্লাবনভূমির প্রতিবেশের বারোটা বাজানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের শুরু। এবং প্রতিবেশ বিরোধী রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থা এখনো চলছে। অবশিষ্ট বনজলাশয় বৃটিশদের দেখানো পথে আরো ভয়ংকরভাবে ধ্বংস করার নাম রেখেছি আমরা উন্নয়ন।

বিশ শতকের শুরুর দশকগুলোতেও প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা নদী-নালা খাল-বিল ছিল। খাল-বিলে কচুরি পানা যোগাযোগ ব্যবস্থার নষ্ট করে দিয়েছিল। দল বাধা কচুরি পানা যোগাযোগ বন্ধ অথবা জলযানের গতি অনেক কমিয়ে দিয়েছিল।

ক্ষতি যত মারাত্মক হয়েছিল ততটা হতো না যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের জন্য ঠিক সময়ে কৌশল নির্ধারণ করা হতো। কচুরিপানাকে নির্মূল করা হবে নাকি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হবে এ ব্যাপারে দোলাচালের মধ্যে ছিল তখনকার রাষ্ট্র। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কচুরিপানা দূর না করে তা নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়েছে। পটাসিয়াম উৎপাদন কিংবা শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার কিংবা ছাই উৎপাদন ইত্যাদি নানা উপায়ে তা ব্যবহারের চিন্তা করা হয়েছে।

বাংলার জনগণের সাথে তামাশার বিরতি হয় ১৯৩৬ কচুরিপানা আইনের (Water Hyacinth Act 1936 shorturl.at/nCFUV) আওতায় নির্মূলের উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে। অথচ একই উদ্দেশ্যে ১৯০৮ সালে কোচিন চায়নাতে (তখনকার ফরাসি কলোনি বর্তমান ভিয়েতনামের অংশ) এবং ১৯১৭ সালে বার্মাতে (তখন বৃটিশ কলোনি, এখন রোহিঙ্গা জেনোসাইডার রাষ্ট্র মায়ানমার) আইন তৈরি করা হয়। ১৯৩৭ এ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কচুরিপানা দূর করার এজেন্ডা যোগ হয়। ১৯৩৯ সালে উপনিবেশি রাষ্ট্র ও জনগণের যৌথউদ্যোগে কচুরিপানা সপ্তাহ পালন করে কচুরিপানার বিরুদ্ধে দুর্বার অভিযান চালায় বাঙালি। কিছুটা সাফল্যও আসে। কিন্তু কচুরিপানা আজো মীর জাফরদের মত রয়ে গেছে। যদিও কন্ট্রোলে আছে অনেকটা তবে বাংলা থেকে নির্মূল হয় নাই। আর নির্মূল হয় নাই বৃটিশ মানসিকতার রাষ্ট্রীয় নীতি। রাষ্ট্র চিরদিন জনগণকে উদ্যমী করার বদলে কচুরিপানা খাওয়া গবাদি পশুর মতন দুর্বল করে রাখে।
....
কচুরি পানা/১৭.০২.২০২০

[রেফারেন্স: কচুরি পানার ইতিহাস লিখেছেন ইফতেখার ইকবাল। “Fighting With a Weed: Water Hyacinth and the State in Colonial Bengal, c. 1910–1947” শিরোনামের লেখা: shorturl.at/fikOW । এই পোস্টের তথ্য উক্ত প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে। আর সাথে বাংলাপিডিয়ার ছোট ভূক্তি shorturl.at/cxPX2 এবং ভেলাম ভ্যান শেন্ডেলের এ হিস্টরি অব বাংলাদেশ।

সতর্কতা: গবেষণাভিত্তিক তথ্য প্রমাণের স্টাইলে এই পোস্ট লেখা হয় নাই। আবেগের যথেষ্ট চিহ্ন আছে শব্দে বাক্যে। কত আর কচুরিপানা খাওয়া যায়। কচুরি ত নয়, এ যে কচুরি পানা।]

Delulu and Danger of Innocence of Law

The persistent political crisis in Bangladesh is often framed as a binary dilemma: is the nation suffering from a flawed political culture, ...