মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়; আরেকদল ইসলামের। এদের রাজনৈতিক দ্বন্ধ পরস্পরকে প্রাণশক্তি দেয় তাদের টোটালিটারিয়ান বয়ানের মাধ্যমে।
কবি বলেছেন বয়ান আর সত্য আলাদা।
১৯৭১ এ পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, আর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে ইসলামসম্মত করার কোন সুযোগ নেই। পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধকে ইসলামের পক্ষের দাবি করা ইসলাম বিরুদ্ধ কাজ। তবু এ বিষয়ে যে রাজনীতি ডিনায়াল আর দেলুলুর মধ্যে আছে তা বাংলাদেশের মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
পাকিস্তান আর ইসলামকে সমার্থক করে দেখার মাধ্যমে ইসলামের একধরনের রাজনৈতিক মালিকানা আদায়ের চেষ্টা রয়েছে। এতে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক বিপদ পুনরুৎপাদিত হয়। মূলত এক্সট্রিম সেক্যুলারিজম বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়া এবং ধর্মবিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়েছে এ ধরনের অবস্থানের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বয়ান তৈরির মাধ্যমে। একটা আদর্শিক এবং দার্শনিক তর্ককে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানের মধ্যে একচ্ছত্রভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে।
যারা পাকিস্তান বিরোধিতা আর ইসলামের বিরোধিতাকে এক করে দেখার ত্রুটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। একটি ত্রুটি হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রতি আনুগত্যকে ইসলামের প্রতি আনুগত্য হিসেবে ধরে নেয়া। একথা অস্বীকার উপায় নেই যে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হওয়া এবং তাতে যোগ দেয়াকে বাংলার মুসলমানরা এবং অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সমাধান হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যকে ঈমানের অঙ্গ মনে করা, সেই বয়ানের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুসলমানদেরকে রাখতে চাওয়া এবং এখনো সেই বয়ানকে নির্ভুল মনে করা - বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে বিপদে ফেলেছে। ইসলাম বিদ্বেষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে। এমনকি এই বয়ানে ১৯৭১ সালে মওলানা ভাসানীকেও কাফের ঘোষণা করা হয়েছিল।
৭১ এর পাকিস্তান পৃথিবীর একটি জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছে। ইসলাম, পাকিস্তানের অখণ্ডতা, কিংবা জাতিবাদী শ্রেষ্ঠত্ব - কোন কারনেই এমন গণহত্যা জাস্টিফাই করা যায় না। আন্তর্জাতিক আইনে ধরা হয় এসব এমন অপরাধ যা ইয়ুস কোজেনস। এমন কিছু মৌলিক নীতি যা সকলেই মানতে বাধ্য। এছাড়া ইসলামিক হিউম্যানিটারিয়ান ল অনুযায়ী এসব কাজ অপরাধ। যদিও বাংলাদেশে শরিয়ার জায়গা থেকে এসব অপরাধ কেউ ব্যাখ্যা করেছে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক আইনে সুস্পষ্টভাবেই এসব নিষিদ্ধ এবং অপরাধ। তৎকালীন পাকিস্তানের আইনে তা নিষিদ্ধ অপরাধ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল না; মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি আগ্রাসী আর্মির বিরুদ্ধে এই জনগোষ্ঠীর একটা প্রতিরোধ যুদ্ধ। প্রেক্ষাপট বিচারে একটি জালেম রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে একটা জনগোষ্ঠীর নিজেদের পুনর্গঠনের লড়াইয়ের একটা এপিসোড। (যেই রাষ্ট্র কাঠামো একই সাথে ভৌগলিকভাবে অসম্ভব ছিল। ১৯৪৭ পরবর্তী দুনিয়ায় ভেঙে পড়তে থাকা উপনিবেশ তখনো অনেকের ঘোর কাটাতে পারেনি। অনেকেই দুনিয়ায় উপনিবেশি রাষ্ট্র কাঠামোকে (ভৌগলিকভাবে) স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে ধরে নিয়েছেন। অথবা আদর্শিক কারনে কেউ কেউ ভূগোল অস্বীকার করতে চেয়েছেন।)
মুক্তিযুদ্ধ সেক্যুলারিজম বনাম ইসলামের যুদ্ধ ছিল না। যে কট্টর সেক্যুলারিজম বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়ায় রূপ নিয়েছে সেই বয়ানের একটি পূর্বানুমান (বা ভিত্তি) হচ্ছে ইসলাম আর মুক্তিযুদ্ধ পরস্পর বিরোধী। এই কট্টর সেক্যুলারিজম বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়ায় রূপ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে ইসলাম বিদ্বেষের এই মতলববাজি সেক্যুলার বয়ান মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের ভূমিকা বিষয়ে অনেক সত্য আড়াল করে রাখে। বাংলার হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান - অর্থাৎ ধর্ম নির্বিশেষে এবং জাতি নির্বিশেষে - পাহাড়ি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে জন্মকে সমর্থন জানিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অবস্থান দেখলেও এ বিষয় স্পষ্ট হবে যে ইসলামের নাম চিহ্ন এবং রূহানিয়াতের উপাদান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে।
ধর্মযুদ্ধ নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধ ছিল জালেম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মজলুম বাংলাদেশী মানুষের যুদ্ধ।
বাংলাদেশে ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করানোর মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে যেই দুই গোষ্ঠী প্রাসঙ্গিক থাকতে পারে তাদের মধ্যে সেক্যুলারিজমের কট্টর অংশ (ইসলামোফোবিক) ৭১ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে ধর্মনিরপেক্ষতার সমস্যা হিসেবে সংকোচন করতে চায়। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ‘বৈষম্য’ কিংবা বাঙালির অধিকার বঞ্চনার আর সব ব্যাখ্যা এক্ষেত্রে গৌন হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাখ্যাকে গৌণ করার মাধ্যমে এক স্ববিরোধী বয়ান উৎপাদন করে। এর ফলে আড়ালে চলে যায় এই ভূখণ্ডের মানুষের নিজেদের রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হওয়ার আকাংখ্যা।
ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি রাখার এজেন্ডা যেন বাংলাদেশের মানুষকে আর প্রতারিত না করতে পারে। যদিও অনেকের জন্য ইতিহাসের এই চর্চা আপাত দৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হবে। তবু বাংলাদেশের রাজনীতিকে টোটালিটারিয়ান ভায়োলেন্স থেকে বের করার জন্য ইতিহাসের এই চর্চা দরকার।
-
মার্চ ২৬, ২০২৫

This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International License.