Tuesday, July 24, 2018

ইঁদুর বিষয়ক অভিজ্ঞতা

১. 

জগতের সকল জীব-জন্তুর মধ্যে মানুষই সেরা। অথবা মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। (দুর্জনেরা বলবেন ইহা এনথ্রোপোসেন্ট্রিক বায়াসনেস।) এমন চিন্তায় নিমজ্জিত মানব সমাজে এক অঘোষিত দণ্ডবিধি / যুদ্ধ আইন জারি আছে।

উক্ত আইন অনুসারে ইঁদুরটির মৃত্যুদণ্ড নির্ধারন করা হয়েছিল।

কিন্তু মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নের পদ্ধতি কি হবে তথা কেমনে মারা হবে
এই প্রজাতি বিরোধী ভয়ংকর অপরাধীকে তা নিয়ে বিভিন্ন অপশন খোলা ছিল। যথা: ১. মেটাল (ধাতব) ফাঁদ পেতে হত্যা। ২. খাদ্যে বিষ প্রয়োগে হত্যা। ৩. গ্লু বা আঠার ফাঁদ পেতে ধরা এবং পরবর্তীতে পিটিয়ে/ পানিতে ডুবিয়ে / না খাইয়ে হত্যা। ৪. সরাসরি পানির ফাঁদ ফেলেও হত্যা করার নজির আছে। (এই চারটি দণ্ড থেকে অনুমান হতে পারে ইঁদুরের শাস্তি সবসময় ম্যান্ডাটরি ডেথ পেনাল্টি। অবশ্য বাংলাদেশের একটি আইনে আরো বেশি সংখ্যক বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা আছে। কিন্তু আরো অপশন আছে।) ৫. কোথাও কোথাও মানব জাতি সরাসরি এই মরণকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করে পোষা মাস্তান লেলিয়ে দেয়। গৃহপালিত কিন্তু বাঘগোত্রীয় আধাবিশ্বস্ত বিড়ালেরা এই দায়িত্ব পালন করে। এই পোষা মাস্তান বিড়ালেরা সব সময় ইঁদুরকে খুন করে না, কখনো শুধু দৌড়ানি দেয় আর ভয় দেখায়। (গতসপ্তাহে দুয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সম্মান রক্ষা কমিটির কয়েকজন হুলো যেমনটা করেছিলেন।)

যাহোক ফেসবুকে সর্বোচ্চ ইঁদুর বিড়াল বিষয়ক আলোচনা মানায়। দেবতা নার্সিসাসের আশীর্বাদআক্রান্ত আর উন্নয়ন এবং খেলাধুলা নামক আপিম আক্রান্ত রাষ্ট্রীয় সমাজে (ছে! গাছ থেকে নামার পর এখনও গায়ের গেছোঁ গন্ধ যায় নাই বোধ হয়, তার আবার রাষ্ট্র!) আর বেহতর কি কি থাকতে পারে?

মানুষেরা ইদানিং সিকিউরিটি নিয়ে বিস্তর কথা বার্তা বলে। এমন কথাবার্তার এক মগজ নাড়ানো উত্তর দিয়েছেন নোয়াম চমস্কি। (ইংরাজি ভাষার শুদ্ধাচার আক্রান্তগণ বেস্তর ‘নোম’ লিখেন। তৃতীয় বঙ্গজ সালাফি আলোর ইশকুল।) তো চমস্কি সিকিউরিটির প্রশ্নে বেশি আগ্রহী যেই প্রশ্নে তা হইল - কার সিকিউরিটি? মহান মার্কিন রাষ্ট্র যখন সিকিউরিটির ধুয়ো তোলেন তা আসল প্রশ্নকে ধোয়াচ্ছন্ন করে। সেই আসল প্রশ্নের উত্তর আপনারা জাইন্যা লইয়েন।

আমি অন্য কথা কই। সিকিউরিটি বিষয়টা ‘হোম’ বা ঘরের আরেক নাম। আপনার যখন ফিলিং হোম হয় - তখন তারে নিরাপদ বলা যায়। তো বুইজ্জা লইয়েন আপনার কখন কখন ফিলিং হোম হয়? এখনকার সময়ে ভায়োলেন্সের একচ্ছত্র অধিকারী রাষ্ট্র ভায়োলেন্স আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা শুরু করলে আপনার আর ঘর ঘর লাগে না। তখন কারাগার কারাগার লাগে। মহামতি রাষ্ট্র বাদে মূলত মানুষরেই আপনার সবচে বড় সিকিউরিটি থ্রেট মনে হইতে পারে। ধরেন জাপানের একজন মৌচাষী ভাল্লুকের ফাঁদ পেতে রাখে মৌচাক আর মধুর হেফাজতের জন্য। আর ঢাকার শহর সিসিক্যামেরা আক্রান্ত হয়ে যায় মানুষের ভয়ে। রিকশায় ব্যাগ শক্ত কইরা ধইরা রাখে কিংবা হুড তুইলা রাখে প্রাইভেটকার থেকে বের হওয়া আগ্রহী মানুষের হাত দেখার ভয়ে। সিএনজির লোহার খাঁচার ভিতর থাকে সেই আশরাফুল মখলুকাতদের ভয়ে। (এসবের ভিতরে আরো গল্প আছে - সেই গল্প জানলে হয়তো অতো ভয় পাবেন না, স্বজাতির প্রতি অন্তত মায়ানমারের চাইতে বেশি দয়ালু হইবেন।)

আসল কথায় যাই, মানুষের এই ঘরে সে একেবারে নিরুপদ্রব থাকতে চায়। হাত ছড়ায়ে দিয়ে নাক ডাইকা ঘুমাইতে চায়। মানে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রজাপতি পর্যন্ত সবাই এই ন্যাচারাল রেস্ট ও নেস্ট চায়। মানুষের এই রেস্টিং এবং নেস্টিং তথা বিশ্রাম ও বাসার ভিতরে প্রাইভেসি আর বাইরে সিকিউরিটি জন্মায়। আধুনিক টেকনোলজি তার ঘর বাহির এক করে ফেলছে। আবার রাষ্ট্রের সাথে সে ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং ছবি দিয়া এবং শ্রম ঘামের অংশ দিয়া এক মনিব দাস সম্পর্ক পাতাইছে। অন্তত চোখের সামনে সর্বশক্তিমান দেখার সাধ তার কিছু মিটে তাতে।

অন্য প্রাণীরা কিন্তু মানুষের প্রাইভেসি আর সিকিউরিটিরে তেমন পাত্তা দেয় না। ডরায় মাঝে মাঝে। এমন মারাত্মক প্রাণী দ্বিতীয়টা আর নাই বইলা। মশা মাছি ইঁদুর তেলাপোকা ছারপোকা ইত্যাদি মানুষের হোম ফিলিংয়ে ট্রেসপাস চালায়। মানুষেরও আগে কিংবা মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণী এবং প্রাকৃতিক প্রভাব থেকে সিকিউরিটি মানুষের ঘর তৈরির মনের খুটা। বাঘ ভাল্লুক হাতি সিঙ্গি এখন আর সহজে হামলা করতে পারে না। রাষ্ট্র টেরিটরির উপর ব্যাপক দখল এনে দেয়ার কারনে। কিন্তু ছোট ছোটরা যেমন ইঁদুরটা এখনও সিকিউরিটি ভায়োলেট করে।

আশরাফুল মাখলুকাতের সিকিউরিটি লংঘন এবং শান্তি নষ্ট করার কারনে ইঁদুরটার মৃত্যুদণ্ড হইল। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে অন্য এক পদ্ধতিতে তা কার্যকর হইলো। ঘরের দরজা খোলার শব্দে সে দরজার নিচ দিয়ে বের হলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় আর ঢুকতে পারল না। দু একবার চেষ্টা করল। আবার চার তলা থেকে ঝাপ দেয়ার কোন ট্রেনিং তার ছিল না। কারন সম্ভবত সে গাছ বেয়ে উঠত। সিঁড়ি দিয়ে নামারও কোন সুযোগ তার ছিল না। কারন সিঁড়িতে আরেকজন দাঁড়িয়ে ছিল। তারপরেও সিঁড়ি বেয়ে প্রায় তিন চার ফুট নামল। কিন্তু তার আগেই দরজার সামনে আমার সাথে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলতে গিয়ে তার একটা পা ভেঙে গিয়েছিল বোধ হয়। চিৎ হয়ে পা নাড়াচাড়া করে সিঁড়িতেই শুয়ে থাকল। অসহায় ইঁদুর জন্ম। সাড়ে তিন তলার উপরের সিঁড়ি থেকে তাকে ধাক্কা দেয়া হলো। নিচে পড়ে যাওয়ার ছোট একটা শব্দ চারতলা পর্যন্ত এসেছে।

মানবপ্রজাতির সুপ্রিমেসি নির্দেশক হিংস্রতায় কেমন কেমন বোধ আর ঘর ঘর সিকিউরিটির এক মিশ্র অনুভব। বিষাদ ও হর্ষ। হর্ষ ও বিষাদ। বিষাদ ও ...   
(২৮ জানুয়ারি ২০১৮)

২. 
আমার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পর ইঁদুরটা প্রথমে রেফ্রিজারেটরের নিচে ঢুকল। আজকের পত্রিকা আগায়ে দিলাম পড়ার জন্য। ইংরেজি পত্রিকা হওয়ায় সে পড়ল না। বের হয়ে দৌড় দিল পড়ার রুমের দিকে। সম্ভবত ডিকশনারি আনতে। কিন্তু রুম বন্ধ ছিল। পেপার নিয়ে তার পিছে পিছে গেলাম। আমার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ায় সে এবার বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম। তাই বাথরুম কাম টয়লেটের দরজা বন্ধ করে দিলাম। তাকে সম্ভাষন জানানোর জন্য ফুলের ঝাড়ু নিয়ে আসলাম। লাইট জালিয়ে টোকা দিয়ে দরজা খুলে ঢুকলাম বাথরুমে।
ঢুকে এবার ভিতর থেকে বন্ধ করলাম দরজা। হাই কমোড বেশি হাই হয়ে যাওয়ায় সে নিচে বসে আছে দেখলাম। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। সে কিছুক্ষণ দরজা অবধি ছুটাছুটি করল। তারপর দেখাল যাদু। হ্যান্ড শাওয়ার বেয়ে বেয়ে (শাওয়ার ব্যবহারের জন্য কিনা জানিনা) শাওয়ারের উপর গেল। শাওয়ার দুয়েকবার প্রেস করার চেষ্টা করে আমার দিকে তাকিয়ে ঝাপ দিল কমোডের ভিতর।

তারপর আমার সুবুদ্ধি হলো। তার সুইমিং এবং শৌচকার্য যথাযথভাবে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে কমোডের ঢাকনা লাগিয়ে দিলাম। পানি বাড়ানোর জন্য একবার ফ্লাশও করলাম। এখন সে সাঁতরাচ্ছে। আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।

ভাবছি একটা গান লিখব - সাঁতারের আওয়াজ শুনি।
...
আমার নিজেরও আজ দুপুরে জহু হলের পুকুরের কথা মনে জেগেছিল। সাঁতারের জন্য। রোজার মাসে ব্যাপারটায় ‍যুঁত পাওয়া যাবে না ভেবে সেই চিন্তা বাদ দিয়েছি। (২৫ মে ২০১৮)


৩. 

বোনাস হিসেবে থাকছে একটি রুশ কবিতা। যার অনুবাদক আমি নই। (উৎস:  রস+আলো, জানুয়ারি ২০১৪)

ইঁদুর-বিড়াল
-সেমিওন আলতভ

রাতের আকাশে ভেসে এল বিমানের শব্দ।
‘আমাদের আত্মীয়রা উড়ছে,’ মাঠের ইঁদুর বলল তার কন্যাকে।
‘কারা আমাদের আত্মীয়?’
‘কারা আবার! উড়ন্ত ইঁদুর*।’
‘ইঁদুররা কি সত্যিই উড়তে পারে?’ বিস্ময় প্রকাশ করল ইঁদুর-কন্যা।
‘খুব প্রবলভাবে কল্পনা করলে একসময় সেই কল্পনা সত্যি হয়ে ওঠে।’
পরদিন সকালে গর্তের পাশে বসে ইঁদুর-কন্যা তার সব শক্তি প্রয়োগ করে কল্পনা করতে শুরু করল এবং ভাবতে থাকল, যেকোনো মুহূর্তে সে উড়তে শুরু করবে।
পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক বিড়াল। সে কল্পনা করছিল পেট ভরে খাওয়ার। এবং তার কল্পনা সত্যি হয়ে উঠল তৎক্ষণাৎ।
ইঁদুর-কন্যার কল্পনা কি পূরণ হয়েছিল? বলা মুশকিল।
যেহেতু একেক জনের স্বপ্ন একেক ধরনের, ফলে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে প্রায়ই। একজন স্বপ্নচারীর মৃত্যু হয়, কারণ, বাস্তবায়িত হয় অন্য স্বপ্নচারীর স্বপ্ন।
তাই উপদেশ দিয়ে রাখি: স্বপ্ন দেখার আগে চারপাশটা দেখে নিন ভালো করে। নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনার আশপাশে কেউ স্বপ্ন দেখছে না। নইলে স্বপ্নপূরণ হবে বটে, তবে স্বপ্নটা আপনারটা কি না, নিশ্চিত নই।

* রুশ ভাষায় বাদুড়কে বলা হয় ‘উড়ন্ত ইঁদুর’।

No comments:

Post a Comment

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়...