বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ রেটরিকে আগ্রহী যে কারো কাছে একটি অসাধারণ এবং সফল ভাষণ। রেটরিকের যে তাৎক্ষণিক প্রভাব একজন ওরেটর বা বক্তার আকাঙ্ক্ষিত থাকে এই ভাষণের মাধ্যমে তা অর্জিত হয়েছে।
কিন্তু ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু রেটরিক বা নান্দনিক এক ভাষণে সীমাবদ্ধ নয়। ভাষণের সৌন্দর্য বর্ণনা করে নির্মলেন্দু গুণ তার সেরা একটি কবিতা রচনা করেছেন, ভাষণের ব্যকরণ বিচার করে এর প্রশংসা লিখেছেন আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
এছাড়া এই ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় এর নাম উঠেছে। তবে এই ভাষণের সংরক্ষণে বাংলাদেশের দুর্বলতা লজ্জাজনক। ভাষণের একাধিক ভার্সন আছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। রাষ্ট্রের আইসিটি ডিভিশনের প্রচারিত রেকর্ড, ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশন্স এর প্রচারিত রেকর্ড, এবং সংবিধানে সংযুক্ত ভাষণের লিখিত রূপ – এ তিনটি রেকর্ডে সামঞ্জস্য নেই। তাছাড়া সম্পূর্ণ ভাষণটি কোথাও পাওয়া যায় না। ভাষণটি কত মিনিট লম্বা ছিল তা নিয়ে একাধিক মতামত আছে। রেকর্ড সংরক্ষণের দুর্বলতা তথা ইফিসিয়েন্সির ঘাটতি ছাড়াও বাঙালি কালচারে রেকর্ড সংরক্ষণে সততার ঘাটতিও প্রকট। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে খুবই অদক্ষ। (মুক্তিযুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদের কোন পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকা রেকর্ড সংরক্ষণে ব্যর্থতার বড় প্রমাণ। হিটলারের জার্মানির রেকর্ড সংরক্ষণের দক্ষতার কারনে হলোকাস্টের ভয়াবহতা জানা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে শিখেছে গুম। আর তথ্যগুম শিখেছে বৃটিশ শাসনের অফিসিয়াল সিক্রেসি আইন থেকে।) ৭ই মার্চের ভাষণটিকে কাঁটাছেড়া করা এবং তার পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড না রাখার ব্যর্থতা প্রথমত আওয়ামী লীগের। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাজগত ইতিহাসকে দেবতা ও দানবে বিভাজিত আকারে দেখায় প্রভাবিত – তাই ইতিহাস কাঁটাছেড়া করার মত নির্লজ্জ, হীন, অপমানজনক এক আচরণ এখানে টিকে আছে।
ভাষণের রেটরিক হিসেবে সাফল্য, সৌন্দর্য, স্বীকৃতি, এবং রেকর্ড সংক্রান্ত ব্যর্থতা ছাড়াও এর রাজনৈতিক মূল্য আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতিহীনতার যে কথা বাজারে আছে তা এই ভাষণের সামনে টিকে না। ২৬শে মার্চ যে স্বাধীনতার ঘোষণা কোন অভিনব বিষয় ছিল না তার নির্দেশনা এই ভাষণে পাওয়া যায়।
—
এই ভাষণ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সেই প্রশ্ন করা যায়। যেই শোষন এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান ছিল সেই শোষণ এবং বঞ্চনা কি শেষ হয়েছে?
নাগরিক অধিকার রক্ষার যেই শাসনকাঠামো বানানোর বাসনা এই ভাষণে ঘোষিত হয়েছিল তা কি হয়েছে?
—
আইন দর্শনের একটি প্রশ্ন আমরা আলাপ করতাম। নাগরিকের আইন অমান্য করার অধিকার আছে কিনা? থাকলে কখন? ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের ইতিহাসে civil disobedience এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। যখন কোন শাসক জনগণকে তাদের পছন্দমত সরকার গঠন করতে না দেয়, তাদের সাথে প্রতারণা করে, এবং নির্যাতন নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের অধিকার অস্বীকার করে – তখন জনগণের নৈতিক অধিকার থাকে সরকার এমনকি রাষ্ট্রকে অমান্য করার। ৭ই মার্চে এদেশের জনগণ সেই নৈতিক অধিকারের চর্চা করেছেন। এই অধিকারের আলাপ আইনের কাঠামোর মধ্যে আর মিলবে না। কেননা আইন ঠিক করার প্রশ্ন এখানে জড়িত।
Civil disobedience ছাড়াও এখানে কিছু সাংবিধানিক অধিকার চর্চার বিষয় ছিল। বাকস্বাধীনতা, সমাবেশ, এবং সগঠিত হওয়ার অধিকার। সিভিল ডিজঅভিডিয়েন্স বা মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিংয়ের নন ভায়োলেন্ট এবং নন কোঅপারেশন মুভমেন্ট - সেসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল উদাহরণ ৭ই মার্চ। এই চরম উপায়ের রাজ-নৈতিকতার প্রশ্নের বাইরে বাংলাদেশে বর্তমানে সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক অধিকারগুলো কেমন আছে?
বাকস্বাধীনতা বা ফ্রিডম অব স্পিচের জন্য মানুষের যে Freedom from fear বা ভয়মুক্তির দরকার হয় – রাষ্ট্র কি মানুষকে সেই অভয় সংগীত শোনাতে পারছে? সমাবেশের অধিকার চর্চা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বেআইনি অত্যাচার – পুলিশি হামলা – থেকে মানুষ কি নিরাপদ? বাংলাদেশ কি তার জনগণের সংগঠনের অধিকার চর্চার সুযোগ নিশ্চিত করতে পারছে?
যদি না পারে তবে ৭ই মার্চ নিয়ে তামাশা করার ধৃষ্টতা আপনারা দেখায়েন না।
—
৭ই মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে। মার্চ ৬, ২০২১। নরমাল, ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র।
No comments:
Post a Comment