(আপনারা ভুল ধইরেন না আপাতত; বাঙ্গালী স্টুডেন্টদের world মানে পৃথিবী। Earth চিনানোর ভুগোল শাস্ত্র কিংবা world কে বিশ্ব বানানোর অনুবাদ শাস্ত্র এখনো বিকশিত হয় নাই। পাবলিক মানে সরকারি আর সরকার বিরোধিতা মানে রাষ্ট্রদ্রোহ - এমনসব ভাষিক জটিলতা ভাষাবিজ্ঞানীরা সমাধান করতে না পারলেও হাতিরা পারে। হাতির চারটি পা, আর সমাসের নিয়মে যার হাত আছে সেই হাতি। এইবার বুঝেন, হাতের তলায় পাদপিষ্ট এই ভাষায় সম্ভব। সম্ভব না হলে ননসেন্সও সম্ভব না।)
আপনাদেরকে সার্কাস ছাড়াই হাতি দেখায়ে এইবার ‘হাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী’ আলোচনায় ফেরত আনি। এমন বাক্য স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় আমি লিখেছি কিনা দয়া করে তা জানতে চাইবেন না। তবে মাস্টার হিসেবে আমি স্টুডেন্টদের এমন বাক্য না লেখার পরামর্শ দেই। পরীক্ষার খাতায় মাস্টারদের বিরক্ত না করার সাথে নম্বরের কার্যকারন বিষয়ক অনুমেয় সম্পর্কের কারনে স্টুডেন্ট লাইফে মাস্টারের পরামর্শ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর লেখা সংক্রান্ত কিংবা মৌখিক বক্তব্যে এই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ স্বভাব ত্যাগ করা সহজ কাজ নয়। লোকেরা স্কুল কলেজ ভার্সিটি ত্যাগ করিতে পারে, কর্ম জীবনে অনেকে মাস্টার কিংবা বিভিন্ন প্রকার স্যার মহোদয় হইতে পারে। তবু এই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বানান এবং উচ্চারণ ছাড়িতে পারে না।
গুরুত্ব বাড়ায়ে তুললে লঘুত্বও তীব্র হয়। আর গুরুত্ব যদি মাপার উপায় না থাকে তবে পাটখড়িও চন্দনকাঠ। সম্ভবত চিন দেশীয় প্রবাদ শুনেছি - মহৎ লোকদের অতিরিক্ত মহৎ করে তুললে সাধারণেরা আরো ছোট হয়ে পড়ে। মনের মধ্যে সংকোচ এবং আরো আরো সংকোচের চাপে দেহের চেয়েও ছোট জীবন নিয়ে এদেশে মানুষেরা দিনাতিপাত করে। জড়ো হতে হতে জীবন এখানে জড় বস্তুর নির্ভরতা ছাড়া আর অবশিষ্ট নাই। ন্যাংটা জীবন ওরফে জীববিজ্ঞানের জীব মাত্র হিসেবের মানুষেরা লঘু জীবনের খামতি মেনে লঘুতর এবং লঘিষ্ট সাধারণ গুনিতকের জীবনে নামিয়াছে।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রত্যেকের লঘু গুরুর আলাদা হিসাব আছে।
লঘু-গুরু না মানলে লাঞ্চনার হুশিয়ারি ছোটবেলায় শুনেছি। জীবনে কোনটা লঘু আর কোনটা গুরু তা চিনতে না পারলে সামাজিক যন্ত্রনা অনেক। তবে কোন কোন সমাজে লাঞ্চনা তৈরির ক্ষমতা আর লাঞ্চনা সয়ে যাওয়ার দুর্ভাগ্য লঘু-গুরু নির্ধারক। যতই লাঞ্চিত হবে ততই লঘিষ্ট জীবন; অপরকে যতই লাঞ্চিত করিবে তোমার জীবন ততই গরিষ্ট হয়ে উঠবে। এমনই সামাজিক নিয়মে ভ্যাবাচেকা খাইতে খাইতে এখন আর খাওয়ার জায়গা নাই।
(খাইতে চাই নাই তবুও জীবনে দুইটা চড় আর ধরতে চাই নাই তবু দুইবার দুজনের পা ধরার পর এই সামাজিক শিক্ষা আমার হয়েছে। সামাজিক জীব হিসেবে দুর্বল উপস্থিতি আমি তারপর মেনে নিয়েছি। লঘু-গুরুর সামাজিক বণ্টন আর আমার মূল্যবোধ ও শিক্ষার সাথে মিলে নাই।)
সমাজের কথা বললাম। পরিবারের কথা বলব না। রাষ্ট্রেরটা বলি। রাষ্ট্র তার লঘু গুরু হিসেবের জন্য সংবিধানের ঘোষণা ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ মেনে চলতে বাধ্য। রাষ্ট্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার ক্ষমতার মালিকরাই হবে এমনটাই সংবিধানের বক্তব্য। লঘু-গুরু মাপাতে রাষ্ট্র যদি সংবিধান না মানে তবে বুঝতে হবে রাষ্ট্রের বড় কোন অসুখ বিসুখ আছে।
রাষ্ট্রের যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা অর্ডার অব প্রিসিডেন্স ওরফে পদমানক্রম আছে তা শুধু অফিসারদের অনুষ্ঠানে প্রয়োগযোগ্য। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অফিসারদের কে কাকে সালাম দিবেন আর কে আগে বসবেন সেই গুরুত্ব নির্ধারনে এই পদমানক্রম অনুসরনীয়। পদমানক্রম শুধু পদমানক্রমে উল্লেখিত অফিসারদের পরস্পরের অগ্রাধিকার নির্ধারনে ব্যবহৃত হবে। নন-অফিসিয়াল কম্যুনিটিতে পদমানক্রম কাউকে কোন অগ্রাধিকার দিবে না; বরং এমন কম্যুনিটির রীতি অনুযায়ী তা নির্ধারিত হবে। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স রাষ্ট্রের কাজে নির্বাচিত এবং নিয়োজিতদের গুরুত্ব নির্ধারক। জনগণের সাথে তুলনীয় কোন বিষয় নয়। জনগণের সাথে তুলনা করলে সংবিধান সর্বোচ্চ আইন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। জনগণের সম্মিলিত ক্ষমতার সাংবিধানিক জিম্মাদার হিসেবেই রাষ্ট্রের কাজে নির্বাচিত এবং নিয়োজিতগণ পদমানক্রম মেনে চলেন।
গুরুত্বে পূর্ণ নয় কারা এমন কোন তালিকা কি কোথাও পাওয়া যায়? লঘুত্বের চাপে আছি।
লঘু-গুরু চিনলাম না এখনো। ফেসবুকের লঘুত্ব জীবনের গুরুত্ব নিয়া টানাটানি করে। আমি এই লঘু ও হালকা পোস্ট লেইখা সময় গুরুত্বের সাথে মশকরা করি।
-
মে ২০২০
/লালমাটিয়া, ঢাকা
(ফেসবুকে প্রকাশিত)
No comments:
Post a Comment