রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সেই দুর্বলতাকে শুধুমাত্র সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ করে ফেলার মানে রাষ্ট্রীয় জীবনে অল্প চাওয়ার বিভ্রম। এই বিভ্রমে রাখতে পারলে কোন কোন রাজনৈতিক দলের সুবিধা হলেও বাংলাদেশের জনগণের লাভ হবে না।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংকট সুষ্ঠু নির্বাচন না করতে পারার চেয়ে বিস্তৃত এবং জটিল। সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় সহ বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো ঠিকঠাক করতে সাংবিধানিক সংস্কারের বিকল্প নেই। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্ন সাংবিধানিক সংস্কারের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের পূর্ণাঙ্গ সমাধান হিসেবে নয়।
আজকে বাংলাদেশের সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। ৭২ এর সংবিধানের বৈধতার প্রশ্ন, এবং সেই সংবিধানের দুর্বলতার বাইরে - ৭২ এর পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাংবিধানিক যাত্রা প্রধানত নেতিবাচক। মানুষের অধিকার আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে এই সংবিধানকে বাঁধা হিসেবে হাজির করা হয়েছে বহুবার।এবং সেই প্রয়োজনে সংবিধানকে কাঁটাছেড়াও করা হয়েছে।
.
বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে এ বছর (২০২৩) খুব জরুরি চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। দুটি বই রাজনৈতিক করণীয় কি হবে তেমন অবস্থান থেকে লিখিত এবং বাংলা ভাষায়। আর ইংরেজিতে লিখিত দুটি একাডেমিক গবেষণার বই প্রকাশিত হয়েছে দেশের বাইরে, যা সংবিধানের গতানুগতিক ন্যারেটিব থেকে কিছুটা বেরিয়ে সংবিধানের বিভিন্ন বিষয়ের একধরনের আন্তঃশাস্ত্রীয় অনুসন্ধান। এছাড়া গত বছরের শেষে (২০২২) প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি জরুরি পর্যালোচনা, ৭২ এর গণপরিষদে সংবিধান বিতর্ক বিষয়ে। এখানে বইগুলোর তালিকা করা হয়েছে আপনাদের সাথে পরিচিত করানোর জন্য।
১. ফরহাদ মজহার 'গণ অভ্যুত্থান ও গঠন - বাংলাদেশের গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে' বইয়ে রাজনৈতিক তত্ত্বের জায়গা থেকে রাষ্ট্র গঠন এবং রাষ্ট্র গঠনের ক্ষমতা যে কেবলমাত্র জনগণের (পপুলার সভরেইনটি) সেই ন্যারেটিব হাজির করেছেন। শুধু সংবিধানেই রাষ্ট্রের গঠন সীমাবদ্ধ নয়, এমনকি প্রচলিত রাজনৈতিক বর্গগুলোও যে চিন্তায় অতিক্রম করা প্রয়োজন, সেই প্রয়োজনীয় কাজের কথাই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। এই বইয়ের প্রকাশক রাষ্ট্রচিন্তা।
২. রাষ্ট্রচিন্তার প্রকাশিত আরেকটি বই হচ্ছে হাসনাত কাইয়ূমের 'রাষ্ট্র সংস্কারের রাজনীতি: তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক'। এই বইতে সংক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্য সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং কিভাবে তা করা যেতে পারে তথা একটি রোডম্যাপ হাজির করা হয়েছে।
৩. বাংলা ভাষায় রচিত গত বছরের শেষ দিকে প্রথমা থেকে প্রকাশিত আসিফ নজরুলের 'সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২ - গণপরিষদের রাষ্ট্র ভাবনা' উপরের দুটি বইয়ের সাথে সংবিধান সংস্কারের আলোচনা বুঝার জন্য সম্পূরক বই। এখানে ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনাকারী গণরিষদ 'বিতর্ক' সারসংক্ষেপ এবং পর্যালোচনা করা হয়েছে।
৪. M Rafiqul Islam এবং Muhammad Ekramul Haque এর সম্পাদনায় Springer থেকে প্রকাশিত The Constitutional Law of Bangladesh - Progression and Transformation at its 50th Anniversary সংবিধানের একটা বিস্তৃত কমেন্টারির মত। বইটি কমেন্টারির চাইতে বেশি কিছু হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সংবিধানের বিদ্যমান সংকটগুলোকে তুলে ধরার মাধ্যমে। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে যাতে ঘুরপাক খেতে না হয় সেই জন্য বাংলাদেশের সংবিধান মেরামতের কথা উচ্চারিত হয়েছে এই বইয়ে। এর পাশাপাশি নতুন নতুন কিছু চিন্তাও এই বইয়ে রয়েছে।
৫. Ridwanul Hoque এবং Rokeya Chowdhury সম্পাদিত A History of the Constitution of Bangladesh: The Founding, Development, and Way Ahead - বইয়ে বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে কিছু শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ হাজির করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক যাত্রা যেসব প্রমিজ নিয়ে শুরু হয়েছিল সেসব যে অধরাই রয়ে গেছে গত পঞ্চাশ বছরে সে কথা সংবিধানের একাধিক বিষয়ের আলোচনায় এসেছে। Abusive constitutionalism এর অনেক নমুনা যে বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে সেসব পর্যবেক্ষণও পাওয়া যাবে এখানে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে Routledge থেকে।
.
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার দুর্বলতার কথা আমরা বিভিন্ন মুখরোচক উপায়ে শুনি। বুদ্ধিজীবিদের কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, তারা এখন যা বলছেন তা শুনলে বাংলাদেশ অগ্রসর হবে না - ছফার এমন তীর্যক মন্তব্যের সপক্ষে বহু প্রমাণ হাজির করা যাবে। তবে উপরের বইগুলো থেকে একটা বিপরীত উদাহরণই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিতা এবং একাডেমিক গবেষণা একটা বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারছে না, এবং তা বাংলাদেশের জন্য বহু জরুরি চিন্তা ও আলাপের সূচনা হিসেবে দরকারি; সেই বাস্তবতাটি হচ্ছে - বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত সংকট এবং সাংবিধানিক সংকট।
[৪ নবেম্বর ২০২৩ তারিখে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল।]

This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International License.
No comments:
Post a Comment