Thursday, March 10, 2016

নোভার্টিস মামলার রায়: জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার আওতায় নিয়ে আসার অন্যতম কারন ছিল উন্নত বিশ্বের মালিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি রক্ষা করা। যদিও তা ছিল একটি ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর একরকম চাপিয়ে দেয়া হয় ট্রিপস চুক্তি। বাণিজ্য সম্পর্কিত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বিষয়ক চুক্তি বা ট্রিপস কার্যকর হয় ১৯৯৫ সালে।

এই চুক্তি থেকে বাদ পড়েনি ওষুধ শিল্পও। যা মানুষের বেচেঁ থাকার মানবাধিকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোর জন্য চুক্তির বিধান বাস্তবায়ন করে আইন তৈরির বাধ্য বাধকতা তৈরি হয়। ট্রিপসের আওতায় ওষুধ চলে আসায় ওষুধের ক্ষেত্রে পেটেন্ট এর বিধান রাখা হয়।

চুক্তির ৬৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বাস্তবায়ন করার জন্য ১০ বছর সময় দেয়া হয়। ২০০৫ সালে সেই সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর আরো সাড়ে সাত বছরের জন্য তা বাড়ানো হয়, ২০১৩’র জুলাইয়ে তা শেষ হয়ে যাবার কথা।

চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা কৃষি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল পেটেন্ট এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না, এতে বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশের জন্য চুক্তিটি অসুবিধাজনক ছিল। স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের জনস্বাস্থ্য অধিকারের কথা বিবেচনা করে ২০০১ সালের দোহা ঘোষণার মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্ষেত্রে এই সময় ২০১৬’র ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। (মার্চের শুরুতে ট্রিপস পর্ষদের সভায় পুনরায় সময় বাড়ানোর আবেদন করে স্বল্পেন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো। বিস্তারিত: স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে আরো সময় দেবে ট্রিপস পর্ষদ, আরটিএনএন)।

ভারত ২০০৫ পেটেন্ট আইন:
২০০৫ সালে ভারত চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে পেটেন্ট আইনকে নতুন ভাবে সাজায়। আইনে ওষুধের ক্ষেত্রে পেটেন্ট দেয়ার বিধান রাখা হয়। তবে আইনটিতে স্পষ্ট করে বলা হয় যে, শুধু সত্যিকারের ওষুধ সম্পর্কিত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেই পেটেন্ট দেয়া হবে। আইনের ৩(ঘ) ধারায় বলা হয়, বিদ্যমান কোন বিষয়ের নতুন আকৃতি বা নতুন ব্যবহার পেটেন্ট যোগ্য হবে না, যদি না  এ ধরনের নতুন ব্যবহার বা আকৃতি কার্যকরিতার ক্ষেত্রে গুরুত্ববহ পরিবর্তন নিয়ে আসে।

নোভার্টিস মামলা:
নোভার্টিস একটি সুইজারল্যান্ডের বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি। ওষুধের ক্ষেত্রে গবেষণা এবং উন্নয়নে তাদের বিশ্বখ্যাতি আছে। পৃথিবীর অনেকগুলো দেশে তারা গবেষণা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
২০০৩ সালে তারা মাইলয়িড লিওকোমিয়া (ব্লাড ক্যান্সার)’র ওষুধ ইমাটিনিব মেজিলেইট (বিপণন নাম- গ্লিভেক) তৈরি করে। আর এই ওষুধ ব্যবহারে একজন রোগীর মাসে ২ হাজার ৬ শত মার্কিন ডলার খরচ পড়তো। আর একই ওষুধের জেনেরিক (বর্গীয়) সংস্করণে ব্যবহারে একজন রোগীর খরচ পড়ে ১শত ৭৫ মার্কিন ডলার।

২০০৫ সালে ভারতে পেটেন্ট আইন পরিবর্তিত হওয়ার পর পেটেন্ট অফিস নোভার্টিসের গ্লিভেক সহ অনেক পেটেন্ট আবেদন পরীক্ষা করে।

২০০৬ সালে তারা বেশকিছু কারনে নোভার্টিসের ইমাটিনিব মেজিলেইট বা গ্লিভেকের পেটেন্ট আবেদন খারিজ করে দেয়। এর মধ্যে অন্যতম কারন ছিল- গ্লিভেক ৩(ঘ) ধারা অনুযায়ী বিদ্যমান বিষয়ের নতুন আকৃতি মাত্র। অতএব, গ্লিভেক পেটেন্টযোগ্য নয়।

২০০৬ সালে নোভার্টিস মাদ্রাজ হাইকোর্টে দুটি আবেদন করে। একটি হচ্ছে পেটেন্ট অফিসের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে। আর অপরটি হল ভারতীয় পেটেন্ট আইনের ৩(ঘ) ধারাকে ট্রিপস চুক্তি এবং ভারতের সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা দেয়ার জন্য।

২০০৭ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট নোভার্টিসের বিপক্ষে রায় দেয়। হাইকোর্ট জানায়, ধারা ৩(ঘ) এর আওতায় পেটেন্ট পাওয়ার জন্য কার্যকরিতার ক্ষেত্রে গুরুত্ববহ পরিবর্তন হতে হবে। গ্লিভেক সে শর্ত পূরন করতে পারেনি।

অপরদিকে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজার লোক একটি আন্তর্জাতিক পিটিশন স্বাক্ষর করে। তারা নোভার্টিসকে মামলা তুলে নেয়ার আবেদন জানায় ২০০৬ সালে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের এ আবদেন প্রত্যাখ্যাত হয়।

২০০৯ সালে নোভার্টিস বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির আপিলাত বোর্ডের কাছে যায়। তারা নোভার্টিসের আপিল আবেদন খারিজ করে দেয়। তারা জানায় ইমাতিনিব মেজিলেইট পেটেন্ট আইনের ৩(ঘ) ধারার শর্ত পূরণ না করায় পেটেন্ট পাবে না।

২০০৯ সালে নোভার্টিস ভারতের সুপ্রিম কোর্টে নতুন মামলা দায়ের করে। তারা পেটেন্ট আইনের ধারা ৩(ঘ) এর ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করে।

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে নয়া দিল্লিতে অবস্থিত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নোভার্টিসের মামলার শুনানি শুরু করে।
২০১৩’র ১ এপ্রিল সোমবার সুপ্রিম কোর্ট নোভার্টিসের বিপক্ষে রায় দেয়।

নোভার্টিসের প্রতিক্রিয়া:
নোভার্টিস বলছে এ রায়ের ফলে ওষুধের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন নিরুৎসাহিত হবে। কারন পেটেন্ট সুরক্ষা নতুন নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে। গবেষণা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। রায়ের ফলে রোগীরা সংকটে পড়বে। ওষুধের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন কমে যাবে।
কিছু পশ্চিমা কোম্পানি নোভার্টিসের পক্ষে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, নোভারটিসের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নতুন নতুন গবেষণায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে পারে।


মামলার বিরোধীদের বক্তব্য:
ক্যান্সার পেশেন্টস এইড অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী আনন্দ গ্রোভার বলেন, ‘দরিদ্রদের সহনীয় দামে ওষুধ প্রাপ্তিতে এটা দীর্ঘদিন সহায়ক হবে।’

পেটেন্ট দেয়া হবে না তা আমরা বলছি না। বরং উদ্ভাবন ছাড়া সামান্য ব্যাবহারিক বা আকৃতি গত পরিবর্তনে পেটেন্ট দেয়া উচিত না। এতে পেটেন্ট এভারগ্রিনিং করা হয়। অর্থাৎ আংশিক পরিবর্তন এনে বিদ্যমান একটি বিষয়ে আবার নতুন করে পেটেন্ট গ্রহণ করার মাধ্য্রম অনেকদিন ধরে পেটেন্ট সুরক্ষা ভোগ করা। এতে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসা করার সুযোগ থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই পেটেন্ট এভার গ্রিনিং কোন দেশে বৈধ নয়।

২০০৬ সাল থেকেই নোভার্টিসকে মামলা তুলে নেওয়ার আবেদন করতে থাকে।
২০০৭ সালের আগস্টে ওষুধ উদ্ভাবনের সাথে জড়িত একজন বিজ্ঞানী জানান, “যে দামে নোভার্টিস ইমাটিনিব বিক্রি করছে তা আমাকে খুবই অস্বস্তিতে ফেলেছে। ওষুধ উন্নয়নে বিনিয়োগকারী ফার্মাসিটিক্যাল কম্পানির প্রতিদান পাওয়ার অধিকার আছে।  কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তারা এই একচেটিয়া অধিকারের অপব্যবহার করে অতিরিক্ত চড়া দামে এবং সামান্য পরিবর্তন করে পেটেন্ট করবে। এটা পেটেন্ট ব্যবস্থার বিরোধী। এবং সুদীর্ঘ সময় ধরে সরকারি ভাবে বিনিয়োগ হয়ে যে ওষুধ তৈরি হত সে বিচারে বৈধ না।

উল্লেখ্য নোভার্টিসের দাবি ওষুধের দাম ওষুধের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা নয়। অথচ একই ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ অনেক কম দামে পাওয়া যায়। অবশ্য এর কারন জেনেরিক সংস্করণের উৎপাদকরা গবেষণা এবং উন্নয়নের ব্যয়বহুল বিনিয়োগ করেন না। তারা ব্রান্ড ছাড়া স্বল্প দামে একই ওষুধ তৈরি করেন। এ ক্ষেত্রে বহুজাতিক কম্পানিগুলো অনেক ব্যয়বহুল গবেষণা এবং উন্নয়ন পরিচালনা করে থাকেন। তবে আগে এসব গবেষণা সরকারিভাবেই হত। এখন তা বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে।

জেনেরিক সংস্করণ:
সাধারণভাবে পেটেন্ট’র মেয়াদ শেষ হলে এমনিতেই কোন ওষুধের জেনেরিক সংস্করণের সুযোগ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে যদি বিদ্যমান কোন ওষুধের সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে পেটেন্ট সুরক্ষা নেয়া হয় তবে সেই সামান্য পরিবর্তিত ওষুধের পেটেন্ট করার সুযোগ থাকবে না।
এ জন্য নোভেল্টি তথা নতুনত্ব বা উদ্ভাবন না থাকলে পেটেন্ট দেয়ার কোন বিধান নেই।

নোভার্টিসের দাবি যে, ভারতের পেটেন্ট আইনের ৩(ঘ) ধারা ট্রিপস চুক্তির পরিপন্থী। মূলত ট্রিপস চুক্তির অনেকগুলো নমনীয় দিকের একটি হল তা পেটেন্ট পাওয়ার যোগ্যতার ব্যাপারে কোন সংঙ্গা দেয় নি। যে কোন দেশ নিজেদের আইন দ্বারা সেই শর্ত ঠিক করে নিতে পারে। ভারতের ২০০৫ সালের পেটেন্ট আইনটিতে সেই সুযোগ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

রায়ের ফলে এইচ আই ভি সহ বিভিন্ন রোগের জন্য স্বল্পমূল্যে ওষুধ প্রাপ্তির সুযোগ সুসংহত হয়েছে। ভারত বিভিন্ন দেশে স্বল্পমূল্যে ওষুধ রপ্তানি করে। নোভার্টিসকে পেটেন্ট দেয়া হলে তা অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে যেত। গরীব মানুষের স্বাস্থ্য অধিকারের প্রাধান্য পেয়েছে আদালতের এই রায়ে।


বহুজাতিক কম্পানির করণীয়:
বহুজাতিক কম্পানিগুলোর জন্য বিকল্প পথ খোলা আছে। তারা এখন স্থানীয় জেনেরিক সংস্করণ উৎপাদনকারীদেরকে স্বল্প মূল্যে জেনেরিক সংস্করণ উৎপাদনের অনুমতি দিয়ে চুক্তি করতে পারে। এতে গরীব জনগোষ্ঠীর ওষুধ প্রাপ্তি বাধাগ্রস্থ হবে না।
ভারত অনেক দেশে স্বল্পমূল্যে জেনেরিক সংস্করণের ওষুধ রপ্তানি করে। রায়ের ফলে ভারতের সেই সুযোগটি অক্ষুন্ন রয়েছে। নোভার্টিসের ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি হল, আগেরটার চেয়ে নতুন ওষুধের পার্থক্য খুবই সামান্য। গ্লিভেকের পেটেন্ট গৃহীত হলে দরিদ্র দেশগুলোতে সস্তায় ওষুধের জেনেরিক ভার্সন প্রাপ্তি হুমকির মুখে পড়তো।

বাংলাদেশ:
বাংলাদেশে বিষয়টি পেটেন্ট এবং ডিজাইন আইন ১৯১১ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাতে সব ধরণের পেটেন্ট সুরক্ষার সুযোগ আছে। অবশ্য ২০১২ সালে সংসদে পেটেন্ট বিল উত্থাপিত হয়। এখনো তা আইনে পরিণত হয় নি। পেটেন্ট আইন ২০১২ নামক বিলটির ৩ ধারার (২) উপধারার (ক) তে আছে, ‘১ জানুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত ঔষধপণ্য’ পেটেন্ট সুরক্ষার আওতা বহির্ভূত হবে।

(১ এপ্রিল, ২০১৩।।আরটিএনএন)

No comments:

Post a Comment

Delulu and Danger of Innocence of Law

The persistent political crisis in Bangladesh is often framed as a binary dilemma: is the nation suffering from a flawed political culture, ...