Thursday, March 10, 2016
নৌ পরিবহনমন্ত্রীর তেমন ব্যাপারের গাইডলাইন
বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ‘তেমন কোনো বিষয় না’ আর ‘এমন টুকিটাকি ঘটনা হতেই পারে’ মন্তব্যের জের ধরে আলোচিত হচ্ছেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান।(প্রথম আলো/৯.৩.২০১৬।) মন্ত্রীর কথা মনযোগ দিয়ে শুনলাম। প্রথম আলোর এক মিনিট চার সেকেন্ডের রেকর্ড। তার আপত্তির জায়গাটা স্পষ্ট। পহেলা বৈশাখের ঘটনাকে সরকারের আইন শৃংখ্যলা রক্ষার ব্যর্থতা হিসেবে সমালোচনা করা হয়। অথচ এমন জনবহুল শহরে এমনটা ঘটতে পারে। উন্নত দেশেও ঘটে।
১. ‘উন্নত দেশ’ একটি জনপ্রিয় কষ্টিপাথর
উন্নত দেশে ঘটলে সেটা ঠিক, মানে ইউরোপ আমেরিকায় কোন কিছু ঘটলে তা বাংলায় ঘটতে পারে তাতে তেমন কোন সমস্যা নেই। ইউরোপ চোর হইলে বাংলা ছ্যাচড় হইতেই পারে। অথবা ডাকাতও। শুধু ঘটতে পারে তাই না, বরং পরিমাণ এবং তীব্রতার বিচারে বেশি ঘটাও জায়েজ। এই রকম ‘উন্নত দেশ’ দিয়া মাপার প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত বঙ্গ সন্তানদের মধ্যে বেশি। যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সেইসব বাংলাদেশীর মধ্যে।
আর এই সমাজেই আরেকটা ধারা যারা কোন কিছু জায়েজ করার জন্য মানদণ্ড মানে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরবকে। এরকম ওয়াজ তো জীবনে কম শুনি নাই যে, সৌদি আরবে নাই, অথচ বাংলাদেশে এমনটা করে। (সেসব যুক্তির বৈধতা বা যেসব বিষয় নিয়ে সেই তর্ক সেগুলোর ব্যাপারে কথা বলছিনা।) যে বিষয়ে ফোকাস করার চেষ্টা করছি তা হলো- অন্যদেশ বা সমাজকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে মাপার প্রবণতা আমাদের সমাজের জনপ্রিয় পদ্ধতি। (একই সাথে এই সমাজের চিন্তায় পরনির্ভরশীলতার প্রমাণ। গোটা সমাজ সম্পর্কে একটা আপেক্ষিক অনুমান।)
আমি বলবো না যে নৌ পরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খান চিন্তার ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল। (তথা ইগনোরেন্স হাইপোথেসিস এখানে খাটবে না।) আমি ধরে নিতে চাই তিনি এবং তারা অনেক কিছু অনেক ভালভাবে জানেন। আর রাজনীতি করতে গিয়ে তারা এটা খুব ভালই বুঝেন এবং চর্চা করেন যে, কোন ভাষায় কথা বললে বক্তৃতাটা জনগণের বোধগম্য হয়। তাই বক্তৃতায় তারা জনপ্রিয় ভাষা ব্যাবহার করবেন এটা স্বাভাবিক।
২. পহেলা বৈশাখের ঘটনা সরকারের আইন শৃংখ্যলা রক্ষার ব্যর্থতা নয়।
একটি লেজসহযোগে এই কথা সত্য। যারা এটাকে আইন শৃংখ্যলার ব্যর্থতা হিসেবে ব্যবহার করছেন তাদের উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ/ সরকার বিরোধী ইস্যু খুঁজে বের করা। সরকারবিরোধী ইস্যু বিষয়টি খুব সাড়াজাগানো ছিল। মানে অনেক মানুষ তাতে কথা বলার স্পেস তৈরি করলো। আর সরকার মানে যেহেতু আওয়ামীলীগ কাজেই অপরাধী যেকোন মূল্যেই বিরোধী রাজনৈতিক মতের হতে হবে। (অনেক মিডিয়া কিছু মানুষের কেশগুচ্ছ আর পাঞ্জাবি পেয়ে গেল। আর সমীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গাণিতিক দক্ষতা বার্ট্রান্ড রাসেলকে হার মানাবে। সমীকরণ তৈরি হলো- দাঁড়িপাঞ্জাবি=জামাতশিবির। মজার ব্যাপার হইল বাংলাদেশে যত দাঁড়ি পাঞ্জাবিঅলা আওয়ামীলীগ বিএনপি দেখেছি তার তুলনায় দাঁড়ি পাঞ্জাবিঅলা জামাতশিবিরের পরিমাণ অনেক কমেই হবে।)
বাম-ডান সবাই মোটামুটি সরব হলেন। সরকার পুলিশের লাঠি পানি বুটজোতা ব্যবহার করল। লোকেদের উত্তেজনা কমাইল।আওয়ামীলীগ বিজয়ী হলো।
এতকিছুর মধ্যে কিন্তু বুঝা গেল না কার ব্যর্থতার কারনে এই ঘটনা ঘটল।
একজন অবশ্য কাজের কথা বলেছিলেন, নারীরা উৎসব উদযাপনে উপস্থিতি বাড়িয়ে দিলে নারীদের প্রতি এই ধরনের আচরণ কমবে। উৎসবে নারীর উপস্থিতি সক্রিয়তা বাড়ুক।
কিন্তু নিপীড়নের এই সমস্যা তো আছে। যারা ইসলামের আংশিক ওয়াজ করেন তারা নারীদের পর্দা করতে বলেন। অথচ পর্দার আয়াত পুরুষের জন্যও। আর নারীর মজলুম হওয়া থেকে তারা সরে গিয়ে আলোচনা শুরু করেন নারীর ধর্মলঙ্ঘন নিয়ে। যে পুরুষ নারী নিপীড়ক তার ধর্ম ঠিক থাকে কেমনে! এসব নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা অনেকেই জানেন, বলেনও। এখানে বলছি না।
প্রশ্ন হলো- নারীর নিপীড়নের ঘটনা কি ঘটতে পারে? উত্তর হলো বাংলাদেশের মতো সমাজে ঘটে এবং ঘটতে পারে। কারন আপনি জানেন এই সমাজ একটি সমস্যাগ্রস্থ সমাজ। নারী বিরোধী সমাজ। দরিদ্র নিপীড়ক সমাজ। নিপীড়ন ঘটবে।
সত্যিকারভাবেই এই ঘটনা সরকারের ব্যর্থতা না। তবে যদি সরকারের ব্যর্থতা খুঁজেন তা আছে- সেটা হচ্ছে নিপীড়কদের বিচার নিশ্চিত না করার ব্যর্থতা।
আবার আপনি যদি আশা করে থাকেন মন্ত্রী আজকে ঘটনাটিকে একটি ‘তেমন ব্যাপার’ হিসেবে মেনে নিলে আগামীকাল বাংলাদেশ নারীর জন্য নিরাপদ হয়ে যাবে তবে আপনি রবীন্দ্রনাথকে খুশি করতে পারতেন। তার সৃজনশীল পরিশ্রম ব্যয় করে ‘দুরন্ত আশা’ লিখেছিলেন। (মর্মে যবে মত্ত আশা সর্প সম ফোঁসে/অদৃষ্টের বন্ধনেতে দাপিয়া বৃথা রোষে)। আমি আপনারে বাঁধা দেই কেমনে। বরং বঙ্গবন্ধুর নকল করতে পারি- ‘কবিগুরু আপনি এসে দেখে যান, আপনার বাঙালী মানুষ হয়েছে’। অন্তত দুরন্ত আশা করতে জানে।
তবে উত্তর এখনো পাওয়া গেল না। কার ব্যর্থতায় এমন ঘটনা ঘটে। সমাজতত্ব আর সাইকোলজিতে এই দেশে অনেক ডিগ্রি বিতরণ করা হয়- উহারা উত্তর দিক। কবি বলেছেন- ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। তাই আমার ভরসা জ্যোতিষশাস্ত্র। বলি- দোষ অই আসমানের তারার। সবই নক্ষত্রের ফের।
৩. এটা তেমন কোন বিষয় নয়।
মন্ত্রীর এই মন্তব্য তথা দাবিটি সংবাদ মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি ঠিকই বলেছেন। যেখানে এরকম একটা সরকার থাকে এবং যার একজন মন্ত্রী হয়েছেন তিনি- সেখানে অন্য ঘটনা তুচ্ছ। যে দেশে খুনধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা, শিশু নিপীড়ন নিয়মিত ঘটনা, সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাওয়া নিতান্তই উপরঅলার ব্যাপার, বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ লুট হয়ে যাওয়া নিয়মিত ব্যাপার, গুম স্বাভাবিক, বিচারহীন আটক স্বাভাবিক, যেখানে পুলিশি হয়রানি স্বাভাবিক, ব্যক্তিগত তথ্য সরকারকে দেয়া অবশ্য পালনীয় আইন, রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার চুরি ইত্যাদির তালিকাটাই একটা ‘তেমন ব্যাপার’, সেখানে পহেলা বৈশাখে ঘটে যাওয়া নারী নিপীড়নের ঘটনা ‘তেমন কোন ব্যাপার নয়’। আসলেই নয়।
সত্য বলার জন্য নৌপরিবহণ মন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
এখন মন্ত্রীকে গালাগাল দিয়ে এসব লুকালে বরং ক্ষতি। কোনটাকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে সমালোচনা করা ‘তেমন ব্যাপার’ তার একটা গাইডলাইন নেয়া যেতে পারে মন্ত্রীর কথা থেকে।
০৯ মার্চ ২০১৬। গ্রিন রোড
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম
মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়...
-
যার যা কাজ, সে তা ঠিকঠাক করলেই ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ভাল থাকে। মানুষের সুখ-শান্তি বাড়ে। জীবনের জটিলতা কমে। যার যা কাজ, সে যেন তা করে - এই ক...
-
মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়...
-
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট থাকার সময়ে আমাদের পাশের হল - এফ রহমান - এর আবু বকর নামে এক স্টুডেন্ট নিহত হন। ছাত্রলীগের দুইপক্ষের মারামারি...
No comments:
Post a Comment