Saturday, May 2, 2020

শিক্ষার সাথে জীবনের সংযোগ হোক

📚
-কিছু জরুরি বিষয়ের জ্ঞান বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে আমরা পাই না। ব্যতিক্রমি কোন প্রতিষ্ঠানে বা পারিবারিকভাবে সেই শিক্ষা কেউ কেউ পেয়ে থাকেন। এইসব জ্ঞানের অভাব এদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে জীবন-যাপন কিংবা বাস্তবতার দূরত্বের প্রমাণ। শিক্ষা কারিকুলামে দারিদ্র্যের সংযোগও এতে প্রমাণ করা যাবে।

খুব জরুরি অথচ কারিকুলামে নেই এমন তিনটি বিষয় (খাদ্য, শরীরচর্চা, আয়-ব্যয়) এখানে উল্লেখ করছি:

১. 🥘
খাদ্য বিষয়ে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চুপচাপ। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিকুলামে ছড়ানো ছিটানো খাদ্যজ্ঞানের নমুনা বা কিছু মূল্যবোধ খুঁজে পাওয়া যাবে কিন্তু আমাদের জীবনে খাদ্যজ্ঞানের গুরুত্ব কুঁড়ানো মানিক দিয়ে মিটানো সম্ভব নয়। (তাছাড়া সবাই মানিক কুঁড়াতে জানে না; আর সবাই যদি এমনিতেই জেনে থাকে তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কি প্রয়োজন!) আমাদের কিশোর তরুনরা পড়ালেখার উদ্দেশ্যে যখন ঘর ছেড়ে বাইরে থাকে তার নিজের খাবার কিনে রান্না করে খাওয়ার ক্ষমতা বেশিরভাগের থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাদ্যের ভালমন্দ কোনরকম-চলে-মতন মেস ব্যাবসা আর বুয়াদের হাতে নির্ভরশীল। মূলত দুইটা দিকের জ্ঞান খাদ্যের ক্ষেত্রে আমরা স্কুল কলেজ থেকে পাইনা: পুষ্টিজ্ঞান এবং রান্নার জ্ঞান। কোন খাবার শরীরের কেমন উপকার করবে, কিভাবে পুষ্টি অনুযায়ী খাদ্যগ্রহন করা প্রয়োজন? – এই জ্ঞান আমাদের নেই। আমরা দিনের পর দিন অসম খাবার খাই। তাতে পয়সা খরচ হয়, পেটও ভরে কিন্তু শরীরে সাম্য আসে না। আমরা জানি, পুষ্টিজ্ঞান থাকলেই লোকেরা সুষম খাবার খাবে এমন নয়। আমাদের কিশোর তরুনদের কালচারে খাবারের সাম্য এখনো তৈরি হয়নি। শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকরি বাকরির পর সংসার শুরু করলে কারো কারো পুষ্টিজ্ঞান বাড়লেও অনেকেই আগের অভ্যাসের সাথে লড়াই করে আর বের হতে পারেন না। যেমন শুধু ভাত মেপে খাওয়া যে কতটা কষ্টকর আর সাধনার ব্যাপার যারা চেষ্টা করেছেন তারা বুঝেন।

দ্বিতীয় যে বিষয়ের অভাবে আমরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করি তা হচ্ছে রান্নার জ্ঞান। এ বিষয়ে বেশিরভাগের অভিজ্ঞতাই মায়ের রান্না বা পরিবারের রান্নার অভিজ্ঞতা। বর্তমানে অবশ্য রান্নার জ্ঞান উন্মুক্ত। ইউটিউবের কল্যানে যেকোন রান্নার উদাহরন (ডেমো) সহ কাজের জ্ঞান পাওয়া যায়। তবে রান্না শেখার জন্য যে পরিমাণ চর্চার দরকার তা সময়সাপেক্ষ। আমাদের কিশোর তরুনরা শুধু রান্নার জ্ঞান জানলে তাদের জীবন-মান এবং স্বাস্থ্যবৃদ্ধি হবে। আমরা কিশোর তরুনদের স্বাস্থ্যের ভার সস্তা শ্রমের উপর দিয়ে নির্ভার থাকতে চাই। মায়ের হাতের রান্না ছেড়ে কিশোর-তরুনরা বুয়ার রান্নায় নির্ভরশীল। জোয়ার ভাটার দেশের ভাসমান অর্থনীতিতে বুয়াদের সস্তাশ্রম বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছি না; বুয়া হয়ে লোকেরা সস্তায় শ্রম বেঁচুক সেই চাওয়াও আমার নেই। এমনকি হঠাত গজিয়ে ওঠা কসমোপলিটান রেস্টুরেন্ট ব্যাবসার কড়াইতেও কিশোর তরুনদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বরং কিশোর তরুনরা যদি রান্না শেখে তবে বুয়ার সহায়তা নিয়ে তার খাদ্যের মান যথেষ্ট ভাল হতে পারে; পুরোটা নিজেরা করলে সে ত আরো আত্মনির্ভরশীল জীবন পাবে। (রান্নায় আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দরকার নেই এমন অসাধারণ প্রতিভাধর তরুন কিশোররা কি করবেন তা আমি জানি না।) দুয়েকবেলা মুরগিভুনা আর খিচুড়ি রান্নার জ্ঞান দিয়েও এই সমস্যার সমাধান হবে না। নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির জ্ঞান লাগবে আমাদের কিশোর তরুনদের।

২. ⚽️
আমাদের শরীর চর্চার জ্ঞানটাও ভাসা ভাসা। যথেষ্ট খেলাধুলার সুযোগ আমাদের নেই। আবার শরীরচর্চার জ্ঞানও নেই। আমরা পূর্বের যোগ ব্যায়াম, কিংবা পশ্চিমের জিমনেসিয়াম – কোন শিক্ষাই স্কুল কলেজে পাইনা। স্কুলে যে সামান্য পিটি প্যারেডের ব্যবস্থা থাকে তা দিয়ে শরীররক্ষা হবে এমনটা ভাববার সুযোগ নেই। স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় খেলাধুলার সুযোগ সরঞ্জাম নেই। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, হাডুডু ইত্যাদি খেলার সুযোগও এবং সাঁতার কাটার মত পুকুর গ্রামে গ্রামে কমে গেছে। জনসংখ্যা অনুপাতে সাঁতার শেখার ব্যবস্থা নেই; পুকুর যেমন মানুষের তুলনায় কমেছে, মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন – মাছ চাষের ব্যাপক বিস্তার এবং চাষের ক্ষেত্রে প্রচুর মাছের খাবার ব্যবহার – আমাদের পুকুরগুলোকে সাঁতার শেখা ও চর্চার জন্য অনুপযোগী করে রেখেছে। খেলারমাঠ হারিয়ে গিয়েছে শহর গ্রাম সবখানে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘খেলাধুলা হারাম’ নামক ফতোয়া জীবনকে কঠিন করে তোলার আয়োজন করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্যের চর্চা কোথাও থেমে নেই। ঘনবসতির দেশে বসতির ডিজাইনে খেলার মাঠ অনুপস্থিত। মূলত বসতিগুলো কোন নগর বা গ্রাম পরিকল্পনা কিংবা ডিজাইনের মাধ্যমে হয় না। বৈচিত্রের যতই গুনগান করি না কেন, বসবাসের ঘর এবং বসতি বিস্তারের ক্ষেত্রে অবারিত বৈচিত্র এদেশের জন্য অকল্যানের, অভিশাপের। কৃষি জমি বাঁচানোর জন্য গ্রামের ডিজাইন পাল্টানোর কথা বিশেষজ্ঞরা বলেন, তাদের সে পরামর্শ শিশু অধিকার, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিচারেও মেনে চলার বিকল্প নেই।

আমাদের শরীরচর্চাকে গ্রাম শহর সকল বসতির প্লানের মধ্যে আনতে হবে। কালচারের মধ্যে, বসতির আর্কিটেকচারের মধ্যে, আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কারিকুলামের মধ্যে শরীর এবং তার চর্চাকে হাজির করতে হবে। শরীরহীন মন প্রশিক্ষনের শিক্ষা বিপদজন নিশ্চয়ই। শিল্প সাহিত্য আধ্যাত্ম কিংবা আরো আরো তত্ত্বজ্ঞানের শিক্ষায় ফুলানো ফাপানো মনটাকে বয়ে বেড়ানোর জন্য হৃষ্টপুষ্ট শরীর দরকার, তাই শরীরচর্চার জ্ঞান দরকার সবার আগে। আমাদের ঘনবসতি আর অফুরন্ত জনসংখ্যার কারনে শরীরচর্চার দরকার নেই – এমন আত্মঘাতী দাবি কিংবা পাঁচওয়াক্ত নামাজেই শরীরচর্চা বাস্তবায়ন হবে এমন পারলৌকিক স্বাস্থ্যজ্ঞানে বাঙালের শরীর বাঁচানোর সুযোগ নেই। একবার এক বন্ধুকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম – বাঙালরা এগিয়ে যাবে সেদিন যেদিন তার মন্ত্রী আমলা পীর সাহেবরা সহ সব নেতারা ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিবেন।

৩. 💰
আমরা বিজ্ঞাপনী বাজার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আর নিজেদের অক্ষমতা অজ্ঞানতায় বন্দী হয়ে আমাদের অর্থ ব্যবস্থাপনা করি। যেমন একটি অনুমান হচ্ছে- প্রাচীন মহাজনী আমল কিংবা বর্তমানের ক্ষুদ্র ঋন বা কনজুমার লোনের উৎসাহে আমাদের ঋনভিত্তিক চিন্তা সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষুদ্র ঋনের আর ব্যাংক লোনের হিসাব এসব প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব খুঁজলে পাওয়া যাবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক ঋনগ্রস্থতার জরিপ করলে বুঝা যাবে এই দেশের জনগণের (বিশেষত বাঙালি মোসলমান অংশের) অর্থনৈতিক চিন্তা কিভাবে চলছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় জীবিকার উপায় হিসেবে চাকরি ছাড়া আর কিছু ভাবি না। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবো – এই হলো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। জীবিকা হিসেবে চাকরি ছাড়া আর কিছু যে আমরা ভাবতে পারিনা এর কারন যতটা উপনিবেশের ইতিহাসের মধ্যে, সমাধান ততটাই কিংবা তারও বেশি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কারিকুলামে। সম্পদ কিভাবে খরচ করা উচিত তাই যদি না জানি তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আর কি মূল্যবোধ আমরা শিখতে পারি? দান খয়রাত করার শিক্ষা আমরা পরিবার, ধর্ম, এবং সমাজ থেকে পাই। কিন্তু ন্যূনতম আর্থিক ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে পাই না। কিভাবে খরচ করতে হবে সেই জ্ঞানের দান-খয়রাত অংশ বাদ দিলে আমাদের আর কিছুই নেই। এই জ্ঞান না থাকা শিক্ষার ব্যর্থতা। জীবিকার জন্য উপার্জনের বিচিত্র উপায়ের পরিচিতি এবং খরচের ভাল উপায় – এই দুই আর্থিক ব্যবস্থাপনার জ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে আনতে হবে।

জীবিকা যে ব্যক্তির অধিকার সেই শিক্ষা না দিলে সস্তায় বিক্রিযোগ্য কায়িক শ্রমের লেবার আর আংশিক অক্ষরজ্ঞানের কেরানির চাকুরে এবং দানখয়রাতে ইহজগতের সমাধান খুঁজতে থাকা মূল্যবোধের জাহান্নামে আমরা বসবাস করব আরো বহুদিন। যে শিক্ষা জীবিকার উপায় শিখায় না সে শিক্ষা মূল্যবান মানবজীবনের স্বপ্ন সময় সাধনার অপচয়। এমন অপচয় করার ভাগ্য কিংবা সামর্থ্য সবার নেই। কিংবা এমন অপচয় ঐচ্ছিক বিষয় – বাধ্যতামূলক হতে পারে না। (এমন অসম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা সংবিধান অনুযায়ী বাধ্যতামূলক কিংবা ধর্ম অনুযায়ী ফরজ হতে পারে না।)

(প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের কলোনিয়াল এবং নিওকলোনিয়াল কিংবা কর্পোরেট মডেল থেকে বের হওয়ার জ্ঞান এদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি না হলে অতি উচ্চ শিক্ষা বাঙালের সাথে মিলবে না। বিদেশি এন্টেনা ধার করে জ্ঞানের সিগনাল ধরতে হবে। অথবা আরো বহুবছর স্বাস্থ্য শিক্ষা খাদ্য বিষয়ে নয়া উপনিবেশী ডাকাতদের প্রেসক্রিপশন মেনে চলতে হবে।)

শিক্ষার সাথে জীবনের সংযোগ হোক।
-

লালমাটিয়া/ ০২ মে ২০২০

No comments:

Post a Comment

Delulu and Danger of Innocence of Law

The persistent political crisis in Bangladesh is often framed as a binary dilemma: is the nation suffering from a flawed political culture, ...