১. ঐতিহাসিকভাবেই শিক্ষা অর্জনের পর সরকারি চাকরি করার এক অলিখিত নিয়ম (নর্ম) তৈরি হয়েছে। উপনিবেশ আমল বা তারও আগ থেকে শিক্ষিত হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় চাকরি পাওয়ার ধারা চলে এসছে। যদিও তাত্ত্বিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজই হচ্ছে সেই কর্মীশ্রেণী তৈরি করা। শিক্ষার শুরু রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য শেখানোর মাধ্যমে। আর তার পরিপক্বতা রাষ্ট্রের কর্মী হওয়ায়। উপনিবেশ শাসনের সাফল্যের সাথে সাথে এই নর্ম পাকাপোক্ত হয়েছে। তাছাড়া আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিই হয়েছে রাষ্ট্রের জন্য আনুগত্য তৈরি এবং রাষ্ট্রের কর্মী উৎপাদনের জন্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্দেশ্যের সাথে পাবলিক সার্ভিসের জন্য আগ্রহী হওয়ার সামঞ্জস্য বরং সেসব প্রতিষ্টান তৈরির সাফল্যের নমুনা।
তাছাড়া বাংলা মুলুকে পুঁজিবাদের বিকাশ এখনো অসমাপ্ত। পুঁজিবাদের অসমাপ্ত বিপ্লব সমাপ্ত করার নামে অনেকেই তা লুটপাটের মাধ্যমে বেহাত করে দিচ্চে। উপনিবেশ কাল থেকে বাংলা যেই সস্তাশ্রম এবং কাঁচামালের উৎস ছিল/হয়েছে সেসবের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন ছিল না। উপনিবেশকালে শিক্ষা বরং সেসবের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। সম্ভবত উপনিবেশি রাষ্ট্র এবং বাজার শিক্ষার সাথে সমান্তরাল সম্পর্কের মধ্যে ছিল না। এসব প্রশ্ন আলাদা করে বলা যায়, সরকারি চাকরির প্রতি যে ক্রেইজ তা নতুন কোন ব্যাপার নয়। বরং বহুকাল আগে থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির সাথে সরকারি চাকরির সম্পর্ক রয়েছে।
২. সরকারি চাকরির জনপ্রিয়তায় ভাটার সময় তুলনামূলক কম। একইভাবে এখনকার মত বিসিএস ক্রেইজ বা উত্তাল জোয়ারও সবসময় ছিল বলা যাবে না। যেহেতু রাজনৈতিকভাবে বর্তমান শাসনআমল অনেক বেশি আমলানির্ভর - কাজেই পাবলিক সার্ভিসের সুযোগ সুবিধা কিছুটা ইমপ্রুভ করেছে। আর জনগণের ভোটের চেয়ে আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা পাবলিক সার্ভিসের লোকদের ক্ষমতার পরিমান বাড়িয়েছে (এট লিস্ট ইন পারসেপশান)। এছাড়া বর্তমান শাসন যেহেতু মিলিটারি শাসন নয়, তাই মিলিটারি শাসনের সময়কার চেয়ে পাবলিক সার্ভিসের এই ক্ষমতার পরিমান বেশি। সবমিলিয়ে অগণতান্ত্রিক শাসনের সাথে বিসিএস বা পাবলিক সার্ভিস ক্রেইজ গভীরভাবে সম্পর্কিত বলা যায়। বাংলাদেশে বেসরকারি চাকরি বাজারের দাপট কমে যাওয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের জন্য হয়তো ভাল নয়, তবে তা বিসিএস ক্রেইজ তৈরির আরেকদিক; সম্ভবত কারনও। প্রাইভেট সেক্টরকে কতটা পলিটিসাইজ করা হয়েছে, কতটা করলে তার বাঁচার সুযোগ আছে এবং তা ইকনোমিকে সচল রাখতে পারবে - সেসব যারা বুঝেন তারা হয়তো ভাল ব্যাখ্যা করতে পারবেন। এককথায় বললে - বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক শাসন বিসিএস ক্রেইজ তৈরি করেছে।
৩. ব্যক্তির জায়গা থেকে হিসাব করলে বিষয়টা হচ্ছে - পড়ালেখা কেন করে লোকেরা? এতো আয়োজন খরচ সাধনা - এসবের উদ্দেশ্য কি? ভাল জীবন যাপন করা। আধুনিক শিক্ষায় মানুষ হওয়া, সুনাগরিক হওয়া - এসব বায়বীয় উদ্দেশ্যের পাশাপাশি কঠিন কিংবা তরল উদ্দেশ্য হচ্ছে উপার্জনের জন্য সক্ষম হওয়া। শারীরিক শ্রমের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমে উপার্জনের সুযোগ যেহেতু বেশি তাই বিদ্যার্জন দরকারি। এছাড়া ব্যবসাপাতি করার জন্য যে ধরনের ট্রেনিং বা আগ্রহ দরকার হয় তা যাদের থাকে তারা সেগুলো শুরু করে দেয় তাদের সময়মতো।
(আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষার সাথে পরকাল জোড়া দেয়া হয়, আর ক্বওমীতে ইহকালকে একটু বেশি পরিমাণে মার্জিনে রাখা হয়। ধর্মীয় শিক্ষার ভেতর আবার দারিদ্র্যকে মহত করা হয় তুলনামূলক বেশি। সম্পদকে প্রধানত নিন্দা করা হয়।)
যাহোক, যে ভাল জীবন মানের জন্য শিক্ষা অর্জন করে লোকেরা সেজন্য দেশের যে সম্পদ তা যথেষ্ট না। বহু পুরানো কথা। মানুষের যা অভাব তা অসীম, আর সম্পদ সীমিত। বাংলার বেলায় একথা আরো বেশি প্রযোজ্য। বাংলা একটি দরিদ্র দেশ। এ ছাড়া বাংলা আসলে মাটি আর পানির দেশ। সোনার বাংলা শুনতে যত আনন্দ লাগুক, বাংলাদেশে কোন সোনার খনি নেই। দেশীয় উৎপাদনসহ সম্পদ যা আছে তাতে কাড়াকাড়ি প্রচণ্ড। প্রতিযোগিতা না বরং কাড়াকাড়ি। কাজেই ক্ষমতার বদলাবদলির সাথে এখানে লুটপাটের সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক। কে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিবে এটাই এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর একটা প্রধান লক্ষ্য।
পড়ালেখা করে লোকেরা সম্পদের ভাগ তথাকথিত মেরিটের ভিত্তিতে পাওয়ার জন্য। এই নীতিকে লোকেরা বলে মেরিটোক্রেসি বা মেধা তন্ত্র। আর রাজনীতিও লোকেরা করে সম্পদের ভাগ পাওয়ার জন্য। সেই ভাগ পাওয়ার ব্যাপারটা নিয়মকানুন দিয়ে হয় না; তাই তার আলাদা নাম লুটপাট। মধ্যবিত্ত বাঙালি শিক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভাগাভাগির একটা অংশ চায় এবং সেটাকেই সবচেয়ে ন্যায্য মনে করে তাই তার কোটাবিরোধী আন্দোলনের দরকার হয়। একটা নিয়ম তো থাকা দরকার।
মূলকথা হচ্ছে বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস রাষ্ট্রের সম্পদ বণ্টনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। বাকিসব মহত্ত্ব পাবলিক প্রাইভেট এমনকি প্রায় সকল পেশায় কমবেশি পাওয়া যাবে। দরিদ্র মাস্টাররা অবশ্য সম্পদ কম পায় বলে মর্যাদার ভাগ একটু বেশি পায়। এছাড়া ক্লিনারের কাজও যেকোন পেশার মত সমানভাবে মহত। কাজেই পড়ালেখা শেষ করে আপনি একটা ভাল চাকরি চাইবেন এবং চাইবেন লোকেরা আপনাকে বিশেষভাবে মহত মনে করুক - প্রথমটা ঠিক আছে দাদা, পরের বিষয়ে বলতে হয় আসলে পেশার কারনে আপনি যতটা মহত ভাবেন নিজেকে অন্য পেশা ইত্যাদির লোকেরাও তাই।
তৃতীয় ব্যাখ্যার সামারি হচ্ছে যেহেতু রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টনের উপায়ের মধ্যে বিসিএস প্রায় এক নাম্বারে আছে - তাই মানুষের আগ্রহও তাতে বেশি।
(এই লেখায় কেউ দুঃখ পেয়ে থাকলে আমি আপনার সাথে সমব্যথী; এটি কোন একক ব্যক্তির পর্যালোচনা নয়, বরং সমাজ সম্পর্কে অনুমান/পর্যবেক্ষণ।)
এপ্রিল ৪, ২০২২