Friday, April 8, 2022

টিএসসিতে মেয়েদের নামাজের জায়গা

 সুপ্রিম কোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের মুখে গল্প শুনেছিলাম। ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হলে এক লোক রাতারাতি নিজের জায়গায় মসজিদ স্থাপন করেন। যাতে রাস্তার কারনে জমি অধিগ্রহণ করা না হয়। মসজিদকে সম্পত্তি রক্ষার জন্য ব্যবহার করার এই কৌশল সফল হয়েছিল। সড়ক ঘেঁষে সেই মসজিদ এখনো আছে। (ঢাকার সেই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি সেই মসজিদের কারনে মাঝখানে চাপানো এবং ঝুঁকিপূর্ণ মোড়সহ এখনো বাঙালির মহিমা ঘোষণা করছে।) বাঙালি মুসলমান ধর্মকে ব্যবহার করার এমন কূটকৌশল সহজে ভুলবে না।

টিএসসির অডিটোরিয়ামের পাশে চট বিছিয়ে একসময় নামাজ পড়া শুরু করেন টিএসসিতে আসা শিক্ষার্থীরা। কারা এই নামাজের জায়গার প্রথম আবিষ্কারক তা জানিনা। ২০০৮ - ২০১৩ সালের অভিজ্ঞতা আমার। দুয়েকবার ইফতার করতে গিয়ে সেখানে নামাজ পড়েছি। সেসময় টিএসসির টয়লেট ব্যবহার অযোগ্য ছিল। আর টয়লেটের সাথে যে বেসিন সেগুলো অজুর জন্য ডিজাইন করা নয়। বাগানে একটা ট্যাপ বসানো ছিল সেখানে অজু করতে হতো। (মেয়েদের জন্য অজুর জায়গা টিএসসিতে সম্ভবত নেই। ছেলেরা যেভাবে খোলা ট্যাপে বাইরে অজু করেন, মেয়েদের জন্য সেটি সহায়ক ব্যবস্থা নয়।)
টিএসসিতে নারী শিক্ষার্থীরাও নামাজের জায়গা চেয়েছেন। ডেইলি স্টারের খবর অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের যুক্তি হচ্ছে - ১. কেন্দ্রীয় মসজিদে নারী শিক্ষার্থীদের নামাজের জায়গা প্রয়োজনের চেয়ে কম, ২. বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের কমনরুমগুলো - মেয়েরা সাধারণত সেখানে নামাজ পড়েন - বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়ে যায়, ৩. টিএসসিতে ছেলেদের জন্য নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকলেও মেয়েদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।
এসবের সমাধান হিসেবে টিএসসিতে মেয়েদের নামাজের জায়গা চাইছেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রচণ্ড ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। স্পেস ম্যানেজমেন্ট করতে হলে এখানে পলিসি ঠিক করা জটিল। এর সাথে যদি ধর্মীয় আচার-আচরণকে কালচারাল পলিটিক্যাল উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয় তাহলে তা আরো জটিল হয়ে যাবে।
শিক্ষার্থীদের ইফতার (পার্টি) করার জন্য জায়গার অভাব। তারা টিএসসির মত খোলা জায়গায় ইফতার পার্টি আয়োজন করে। মসজিদের তুলনায় জায়গা হিসেবে তুলনামূলক সেক্যুলার স্পেস হওয়ায় সেখানে সবাই অংশ নেয়। ইফতারকে পার্টি বানানোর সাথে সাথে নামাজের জায়গার এই চাহিদা তৈরি হয়েছে। আরো কারন থাকতে পারে।
টিএসসিতে ছেলেদের নামাজের জায়গার বিশেষ কোন রুম নেই। তারা মূলত টিএসসি অডিটোরিয়ামের বারান্দায় নামাজ পড়ে। মাগরিবের সময় যেহেতু অল্প থাকে তাই ভরপেট ইফতার করে সময় থাকতে নামাজ আদায় করা কঠিন হয়। তখন তাড়াহুড়া করতে এই বারান্দার নামাজের জায়গা দরকার হয় ইফতার করতে আসে নামাজীদের। ইবাদতে ধীরস্থিরতা আর নিষ্ঠার সাথে এই চর্চা মিলে না।
ছেলেদের নামাজের জায়গা আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি করা হয়নি, নির্দিষ্ট কোন রুমও বরাদ্দ হয়নি, অস্থায়ীভাবে নামাজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে টিএসসির অডিটোরিয়ামের বারান্দা। মেয়েদের এই স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে ফরমালি নামাজের জায়গা চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি অস্থায়ীভাবে সমাধান করার মত নয়। (ফরমালিটির গুরুত্ব এখনো আছে। কাগজে কালিতে আইনি স্বীকৃতির অবস্থা তৈরি হয়।) উপাচার্য মৌখিকভাবে অনুমতি দিয়েছেন বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে বিষয়টা তেমন সাময়িক ব্যাপার নয়। এ বিষয় বরং আরো চিন্তাভাবনা করে সমাধান করা উচিত। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি জানিয়েছেন তাদের দাবিকে যাচাই বাছাই করে সমাধান দিতে হবে। একইসাথে সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অবকাঠামোগত পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
শিক্ষার্থীদের দেয়া স্মারকলিপি থেকে অনুমেয় (রমজানের সময় আর মাগরিবের নামাজের প্রসঙ্গ হিসাব করে এই অনুমান) - তাদের প্রধানত রমজানে মাগরিবের নামাজের জায়গা দরকার। নামাজের জন্য খুব ভাল ব্যবস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় মসজিদ থাকলেও কেন্দ্রীয় মসজিদে নারীদের নামাজের জায়গা পর্যাপ্ত নয় - এটা তাদের দাবি। তাদের এই দাবি সমাধান করার জন্য টিএসসিতে নামাজের জায়গা বরাদ্দ করা আসলে ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে ভাল সমাধান নয়। বরং কেন্দ্রীয় মসজিদকে বহুতল করা যেতে পারে। সেখানে মেয়েদের নামাজের জায়গা বাড়ানো যেতে পারে। একই সাথে টিএসসিতে ছেলেদের নামাজের জায়গা বলে যা পরিচিত তারা তাকে আনুষ্ঠানিক না করে বরং মসজিদে নামাজ পড়ার চর্চা বাড়াতে পারেন।
কেউ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে যদি এসব দাবি করে থাকেন কিংবা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সেনসেশন তৈরি করতে চান তবে তা আসলে ধর্মের জন্য উপকারী হবে না। এটি বরং আনস্মার্ট কৌশল হবে। কারন টিএসসির অডিটোরিয়ামে কনসার্ট চলবে আর আপনি তার পাশেই খুব একাগ্রতার সাথে ইবাদত করবেন তা আসলে আপনার ইবাদতের জন্য ভাল নয়।
যারা তথাকথিত উন্নত দেশের উদাহরণ জানেন তারা এটুকু জানেন সেসব দেশে স্টুডেন্ট সেন্টারে প্রেয়ার রুমে লোকেরা নাচগান করতে আসবে না, আবার অডিটোরিয়ামের বারান্দাকে কেউ নামাজের জায়গা হিসেবে দখল করবে না। আপনি অতিবেশি পলিটিক্যাল হলে সেসব নাও বুঝতে পারেন; বিশেষত, যদি স্বাধীনতাকে (লিবার্টি) শুধু নিজের মতের সাফাইয়ের জন্য যদি ব্যবহার করেন।
বাঙালের আর্টকালচার এমনিতেই দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। তাতে টিএসসির মত জায়গায় ধুঁকতে ধুঁকতে চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট-কালচার চর্চা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্ট-কালচারে মরে গেল তাকে রাজনৈতিকভাবে মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে উদ্ধার আরো অসম্ভব হবে। নামাজের জায়গা থেকে কোন সৃজনশীলতা তৈরি হবে এমনটা কেউ ভুলেও ভাবে না। টিএসসি-কিছুই তৈরি করেনি এমনটা যারা ভাবেন, তারা নিজেরা শুরু করতে পারেন।
আপনার নামাজ মসজিদ থেকে টিএসসি অডিটোরিয়ামের বারান্দায় কিভাবে গেল সে বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করলে আপনি হয়তো ভাল সমাধান পাবেন। সেসব না ভেবে সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মসজিদ ঘোষণা দিলেও মোসলমানের কোন উন্নতি তাতে হবে না।

এপ্রিল ৮, ২০২২

No comments:

Post a Comment

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়...