Monday, August 16, 2021

আফগানিস্তান ও বাঙালি মোসলমান

 সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক মত – যেকোন দেশেই বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে। বিদেশি হস্তক্ষেপ আর শাসনের বিরোধিতা আর ভেতরের কোন রাজনৈতিক শক্তিকে সমর্থন করা এক কথা নয়। তবুও কেউ কেউ এক করে ফেলার ঝোঁক এড়াতে পারেন না। বাংলাদেশে যারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কারনে আফগানিস্তানে মার্কিন ক্ষমতার পরাজয়ে আনন্দিত তারা এ ঝোঁক এড়ানোর জন্য অপেক্ষা করবেন হয়তো। সোজা কথায় তারা নিশ্চয়ই বুঝেন যে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জন্য তালেবান সমর্থক হওয়ার দরকার নাই।

বাংলাদেশের তালেবান-উৎসাহীদের অনেকে এ কারনে আনন্দিত না যে – তালেবান ন্যায়বিচারক, মানুষের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকার করে, আফগান মুসলমানদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর করে তুলতে চায়, কিংবা আফগান নারীদের অধিকার বাস্তবায়নে তারা উদ্যোগী নাহোক অন্তত সহনশীল; এমন কারনে তালেবান-উৎসাহী হওয়াটা মন্দ হতো না। কিন্তু অনেকের খুশির কারন হচ্ছে তালেবানের মোসলমানিত্ব এবং মোসলমানিত্বের নামে গোঁড়ামি। তালেবানের কট্টর মোসলমানিত্ব তালেবানকে প্রিয় করে তুলছে অনেকের কাছে। এরা মনে করে তালেবান আফগানিস্তানের অন্যান্যদের চাইতে এবং ক্ষেত্রবিশেষ তাদের নিজেদের চাইতে বেশি মুসলমান।
(মূলত উপমহাদেশের মাদরাসা শিক্ষায় এই একটা অহংকার শেখানো হয় যে পোশাক আশাক এবং ধর্মীয় শিক্ষার কারনে এরা অন্যদের চেয়ে বেশি মুসলমান। এমন অহংকারের এক্সট্রিম রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটেছে যেই তাকফীর ধারনার মধ্যে তাকে তালেবান তাদের যুদ্ধনীতিতে ব্যবহার করেছিল। তালেবান বা আলকায়েদার সেই আত্মঘাতী তাকফীর নীতির অর্থ হচ্ছে যে কোন মোসলমান ইসলামের আচার-আচরণ থেকে সরে গেলে অন্য মোসলমানকেও কাফের ঘোষণা করতে পারবে। এবং সেই যুদ্ধ প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফরজ। এই রকম পলিসির মাধ্যমে তারা ইসলাম বা শরীয়ার একটি সামগ্রিক এবং রাষ্ট্রীয় নীতিকে ব্যক্তিগত নীতিতে রূপান্তর করেছিল। শরীয়ার যুদ্ধ আইনকে ব্যবহার করেছিল তারা, যেমনটা হিউম্যানিটারিয়ান ল-কে ব্যবহার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।)
যদিও শিক্ষার কারিকুলাম এবং দর্শনের ক্ষেত্রে দেওবন্দের ধারা তাদের শেকড়, তবুও আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের যেসব মাদরসার তালেবরা তালেবান হিসেবে বিশেষ পরিচিত - সেসব মাদরাসায় সামরিক ট্রেনিং দিয়েছে আমেরিকা। তালেবান সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে আমেরিকার সহায়তায়।
ধর্মীয় শিক্ষার কারিকুলামে দেওবন্দী ধারার প্রতিষ্ঠানের সাথে তালেবানি শিক্ষার মিল থাকলেও সশস্ত্র হওয়ার দিক থেকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের কওমী শিক্ষার কন্টেন্ট বাংলাদেশ-ভারতের ক্বওমী শিক্ষার কন্টেন্ট থেকে আলাদা। এমনকি রাজনৈতিক দিক থেকেও তারা আলাদা। যদিও শিক্ষার কন্টেন্টে মিলের কারনে বাংলাদেশ থেকে আশির দশকে আফগানিস্তানে অনেকে গিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মাদরাসা আর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাদরাসা একরকম না। জঙ্গিবাদ বিরোধী বয়ানে এই পার্থক্য অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে।
তালেবানকে পপুলার অথরিটারিয়ান রেজিম হিসেবে ধরে নিয়ে বলা যায় অথরিটারিয়ান রেজিমে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অধিকার তথা সম্পদ বণ্টনের অধিকারের একটা সুযোগ থাকে। তালেবান আফগান নাগরিকদের জন্য সেই সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে চায় কিনা? নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বেলায় তালেবান গণতন্ত্র নয়, বরং আমিরাত বানাতে চায়। আমিরাত কোন সমাজতন্ত্র না; বরং এমন শাসন যাতে গোত্রতন্ত্র এবং পরিবারতন্ত্রের সুফল-কুফলের সাথে আফগান জনগণের ভাগ্য দুলতে থাকবে। আরো বহু দেশে যেমন ঝুলে। তবে তালেবান যদি গণতান্ত্রিক হতে চায়, নারীসহ আফগান জনগণের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকার করে এবং বাস্তবায়ন করে – তাহলে তালেবানকে অনেক বদলে যেতে হবে। যে বদল প্রকারান্তরে আমেরিকার আদর্শিক বিজয়।
সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম উপন্যাসে এবং দেশে বিদেশে নামক ভ্রমণ কাহিনীতে আফগানিস্তানের অল্প একটু ছবি দেখেছি। সভ্যতার ইতিহাসে সিল্করুটের ঝলমলানি বহু পুরাতন এই দেশ থেকে আলাদা করা যায় না। দেশে বিদেশের সেই বিশালদেহী বিরাটদিল এবং সহজ-সরল আব্দুর রহমানদের জীবন তালেবানি আফগানিস্তানে কেমন হবে, কাবুলসহ আরো সব উপত্যকার শবনমেরা কেবল হারিয়ে যাবে কিনা, সাধারণ আফগান জনতার জীবনের ছবি আপিম ক্ষেতের রোদে পুড়ে কেবলই রিলিফ ম্যাপের মতো হয়ে যাবে নাকি আঙুর লতার ছায়ায় মসৃন আর সতেজ হয়ে উঠবে - আমরা জানিনা। আফগানরা এতদিন কেমন ছিল তা নিয়ে তর্ক বৃথা। তবে মনে রাখা দরকার আপাতত সাধারন আফগান জনগণের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি এনে দেয়ার কোন জাদুমন্ত্র তালেবানের হাতে নেই। অলৌকিকতার আকাংখ্যায় আচ্ছন্ন বাঙালি মোসলমানরা এটুকু বুঝলে হয়!
-
অগাস্ট ১৫, ২০২১

No comments:

Post a Comment

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়...