Saturday, March 11, 2023

ঘরকুনো কচ্ছপ

অনেক গল্পেই ইতিহাসের ব্রহ্মদত্ত রাজা হিসেবে হাজির থাকেন, গল্পেও আছেন। আমার সাথে তার সাক্ষাত হয় নাই, তাহলে তার রাজমুকুটে কয়টা হীরামোতিপান্না ঝলঝল করত তা আপনাদের জানাতে পারতাম। এখন গল্প শুরু করা যাক।

_

এককালে ব্রহ্মদত্ত ছিলেন বেনারসের রাজা। আর বোধিসত্ত্ব জন্মেছিলেন গায়ের এক কুমোরের ছেলে হয়ে। তিনি কুমোরের কারবার দেখাশুনা করতেন। আর এক স্ত্রী এবং পরিবারের ভরণপোষণ চালাতেন। 


সেসময় বেনারসের বিরাট নদীর কাছেই একটা বড়সড় বিল ছিল। বর্ষায় পানি বেড়ে গিয়ে নদী আর বিল একাকার হয়ে যেত আর পানি কমলে তারা হয়ে যেত আলাদা। মাছ আর কচ্ছপেরা এমনিতেই জানতো যে কোন বছর বর্ষায় সব ডুবে একাকার হয়ে যাবে আর কখন খড়ায় সব শুকিয়ে যাবে।


যে বছর এই গল্পের, সে বছর বিলের মাছ এবং কচ্ছপেরা জানতো যে ভীষণ খড়ায় বিল শুকিয়ে যাবে; তাই যখন বিল আর নদী জলে একাকার ছিল তখন মাছ আর কচ্ছপেরা বিল সাঁতরে নদীতে চলে গেল। কিন্তু একটা কচ্ছপ ছিল যে নদীতে যায়নি, সে বললো - ‘আমার জন্ম এখানে, এখানেই বড় হয়েছি আমি, আর এখানেই আমার বাপমায়ের ঘরবাড়ি - আমি জায়গা ছেড়ে যেতে পারব না 


অতপর গ্রীষ্মে পানি সব শুকিয়ে গেল। সেই কচ্ছপ একটা গর্ত খুঁড়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখলো, যেখানে বোধিসত্ত্ব মাটি নিতে আসতেন। 


হাড়ি পাতিল বানানোর জন্য মাটি সংগ্রহের সময় হলো কুমোরের। বোধিসত্ত্ব আসলেন মাটি নেয়ার জন্য। বড় একটা কোদাল দিয়ে তিনি মাটি খুঁড়লেন। তাঁর কোদালের কোপে কচ্ছপের শক্ত খোলস ভেঙে গেলো, কোদালের সাথে উঠে মাটির দলার মত পড়ে রইল সে। নিদারুণ যন্ত্রণার ভেতর সেই প্রাণী ভাবল - ‘এই আমি মরে যাচ্ছি, কারন আমার ঘরের প্রতি এতটাই আসক্ত ছিলাম যে তা ছাড়তে পারি নাই।তারপর সে এক শোকের গীত গাইলো:


এই মাটিতে জন্ম আমার, ঘরও ছিলো, বড় হলাম ছোট থেকে;

এই মাটি আজ আমার জন্য মরণখেলা আনলো ডেকে।

তোমারে কই,  ভাগ্য অমার, তোমারে কই একটু শোনো -


সুখ যদি পাও যাও সেখানে, হওনা সেথায় অচিন তুমি;

উজল শহর/গহিন বনেও, প্রাজ্ঞরা পায় জন্মভূমি।

যাও সেখানে, জীবন যেথা; ঘরেই কেন মরণ বোনো?


মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে বোধিসত্ত্বর কাছে তার শোকের গীত গাইতেই থাকলো। বোধিসত্ত্ব তারে তুলে নিলেন এবং গ্রামের সব লোকরে জড়ো করে নসিহত করলেন: ‘এই কচ্ছপটারে দেখো। যখন অন্য মাছ এবং কচ্ছপরা বড় নদীতে গেল, সে তার ঘরের আরাম ছাইড়া যাইতে পারলো না। সে নিজেরে লুকাইলো আমি যেখান থেকে মাটি আনি সেই মাটির ভিতর। আমি তখন মাটি খুুঁড়তেছিলাম আর আমার বড় কোদাল দিয়া তার খোলস ভাইঙ্গা ফেললাম। একটা বড় মাটির দলা ভাইবা আমি তারে কোদাল দিয়ে টাইনা তুললাম। তখন সে আমারে বললো সে কি করেছিলো। দুই শোলক কবিতায় সে তার করুণ ভাগ্যের কথা বিলাপ করে কইলো আর এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো।


তোমরা দেখতে পাইতেছো যে সে তার ঘরের প্রতি খুবই আসক্ত ছিল। তোমরা এই কচ্ছপের মত হয়ো না। নিজেরে বুঝায়ো না যে, ‘আমার চোখ আছে, আছে কান, এখনো ঘ্রাণ পাই, পাই স্বাদ, স্পর্শে এখনো বুঝি, আছে এক ছেলে আর মেয়ে এক, আমার সেবা যত্নের জন্য আছে অনেক কাজের লোক - কাজের বেটি, আছে অনেক স্বর্ণ খাটি।গভীর কামনা বাসনায় এইসব আঁকড়ায়ে থাইকো না। সব প্রাণই অস্তিত্বের তিনটা স্তর পার করে।


এভাবেই তিনি বুদ্ধ স্টাইলে ওয়াজ করলেন উপস্থিত জনতারে। তার সেই নসিহত ভূভারতের সর্বত্র ছড়ায়ে পড়লো এবং সাত হাজার বছর ধরে মানুষ মনে রাখলো সে ওয়াজ। জনতা তা মনে রাখলো, দান সদকা করলো, এবং স্বর্গে যাবার আগ পর্যন্ত মানলো সেই নসিহত।

_

ঘরকুনো কচ্ছপ জাতকের গল্প ইংরাজি থেকে অনূদিত; গীতটুকুও 

_

#পাগলা_ডুমুর

_


Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International License.

No comments:

Post a Comment

Delulu and Danger of Innocence of Law

The persistent political crisis in Bangladesh is often framed as a binary dilemma: is the nation suffering from a flawed political culture, ...