জনপ্রিয় ফরাসি দার্শনিক আলাঁ বাদিয়ু মনে করেন সুখ মৌলিকভাবেই সাম্যময় এবং আপাত অসম্ভব এই সুখের দাবি একটি সর্বদা সক্রিয় কর্ম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিকোলাস ট্রুঙঁ। মূল ফরাসি থেকে ইংরাজি অনুবাদ করেন ডেভিড ব্রডার। (ভাললাগার প্রভাবে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। সঠিক হওয়ার নিশ্চয়তা নাই। ইংরেজি ভার্সনের লিংক লেখার শেষে দেয়া আছে।)
কোন ঘটনাগুলো আপনার জীবনের গতি পথ ঠিক করে দিয়েছে?
আলাঁ বাদিয়ু: থিয়েটার এবং দর্শনের আগে আমার বাবার কিছু কথা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি হওয়া এ সম্পর্কিত স্ক্রিন মেমরি আমার পরবর্তী জীবনের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে মূল ঘটনা। আমার বয়স তখন ৬ বছর। আমার বাবা প্রতিরোধ যুদ্ধে ছিলেন। (এ কারনে স্বাধীনতা পরবর্তীতে তাকে তুলৌসের মেয়র বানানো হয়।) যুদ্ধের সময় রুশ ফ্রন্টের অগ্রগতি নজরে রাখতে সামরিক অপারেশনের একটা বড় মানচিত্র তিনি টানিয়ে রাখেন। মোটা দড়ি পিন দিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে সম্মুখভাগ চিহ্নিত করা হয়েছিল।
আমি বেশি প্রশ্ন করতাম না। আমি দেখলাম যে দড়ি আর পিনগুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যাচ্ছে। গোপনে থেকে অপারেশন পরিচালনায় ব্যস্ত আমার বাবা সন্তানদের সামনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয় এড়িয়ে যেতেন। ১৯৪৪ সালের বসন্ত কাল। সোভিয়েতদের ক্রিমিয়ায় হামলা চলাকালীন একদিন দেখলাম যে বাবা দড়ি এবং পিনগুলো আরো বাঁয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যাতে স্পষ্ট দেখা গেল যে, জার্মানি পশ্চিম দিকে পিছু হটছে। নিজেদের দখল করা অংশ থেকে পিছনে সরাই শুধু না এখন বরং তারাই বিরাট এলাকা হারাচ্ছে। আমার তাৎক্ষণিক বুঝ থেকে আমি তাকে বললাম: ‘শেষমেশ মনে হয় আমরাই যুদ্ধে জিতব?’ এবং এই একবার তিনি খুবই স্পষ্ট জবাব দিলেন: ‘কিন্তু আলাঁ, আমাদের প্রয়োজন জয়টা চাওয়া’।
এই কথাটাই আপনার সুত্র হয়ে গেল?
উত্তরটা ছিল সত্যিকারের পিতৃসুলভ বাণী। আমি তার বিশ্বাসের উত্তরাধিকার হয়েছি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা কি তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা যা চাই এবং যা সিদ্ধান্ত নেই তাই আসল গুরুত্বপূর্ণ। তখন থেকেই আমি প্রায় সবসময় প্রভাবশালী মতামতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এসেছি। কারন এসব মতামত সবসময় রক্ষণশীল। এবং ‘কোনকিছু এখন আর ফ্যাশন না’ এমন বিশ্বাসে আমি কখনোই বিদ্রোহ করা বাদ দেই নি।
ইচ্ছা’র উপর আপনি অনেক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য দার্শনিক ধারা - তথা স্টইসিজম- মানুষকে সুখী হওয়ার জন্য যা ঘটছে তা ঘটতে দেয়ার পরামর্শ দেয় এবং নিজের ইচ্ছাকে নিয়তির উপর সঁপে দিতে বলে। পৃথিবীকে বদলানোর চেয়ে তা যেভাবে আছে সেভাবে গ্রহণ করাই কি প্রজ্ঞার পরিচয় নয়?
১৯৪০ এর দশকে আমাদের নিয়তি ছিল যুদ্ধে হেরে যাওয়া। তাহলে কি একজন স্টইক একথা বলবেন যে, প্রত্যেকেরেই একজন পেতানবাদী হওয়া যৌক্তিক? মার্শাল পেতান যখন প্রাদেশিক ফ্রান্সে গিয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত বিজয়ীবীর। যেমন অনেকেই ভাবতেন যে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষা করেছিলেন।এমন ভাবনার সাথে কি আমরা একমত হতে পারি? আমি স্টইসিজমে আস্থা রাখি না- অজস্র সম্পদের অধিকারী সেনেকার সেই স্টইসিজম যেখানে তিনি সোনার বাথটাবে শুয়ে মানুষকে তাদের নিয়তি মেনে নিতে বলেন।
অবশ্য আরো বিশদ বস্তুবাদীরা তথা এপিকিউরিয়ানরাও ছিলেন। যারা মনে করতেন পৃথিবীর নিয়ম কানুনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনকে নিরর্থক ঝুঁকির মধ্যে ফেলা বোকামি। কিন্তু সেই মতামত আমাদের কতদূর নিয়ে যায়? বর্তমান মুহূর্তের মজা পর্যন্ত। বলা চলে হোরেস (গ্রীক কবি)-এর বিখ্যাত ‘কারপে দিয়েম’ (সিজ দ্যা ডে/ দিনটাকে ধরো) পর্যন্ত? তা অবশ্য অবাক করা কিছু নয়। এইসব প্রাচীন প্রজ্ঞায় স্বার্থপরতার এক মৌলিক উপাদান বিদ্যমান। আর তা হল- পৃথিবী যদি অন্য মানুষদের জীবনকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তোলে তবুও তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হওয়া যাবে না বরং সাবজেক্ট (সহজ মানুষ) কে পৃথিবী যেমন আছে তার মধ্যেই একটি নির্ঝঞ্জাট জায়গা খুঁজে পেতে হবে।
এইসব স্বার্থপর এথিকস-এর উৎপত্তি কোথায়?
এই ধরণের দার্শনিক চিন্তা রোমান সাম্রাজ্যে উৎকর্ষ লাভ করেছিল। আর রোমানদের ঐতিহাসিক অবস্থা আমাদের সাথে অনেকটাই মিলে যায়। তা হলো: একটা বৈশ্বিক আধিপত্য চলছে। যা বিদ্যমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় কোন কিছুর বিরোধী কোন কিছু চর্চা করা বা নির্ধারণ করার সুযোগ দেয় না। আর এই ব্যবস্থা এ ধরনের অবস্থায় নিজের জন্য সম্ভাব্য সবচে ভাল জায়গাটা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সর্বত্র একটি ধারণাকেই উৎসাহিত করে। সেই ধারনাটি হল- আমাদের উচিত এই ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়া।
বাস্তববাদী দার্শনিকরা কি তাহলে বলবেন যে, ‘চলো আমরা দুনিয়াকে বদলানোর যে কোন দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দেই। বরং আমরা খাঁচার ভেতর আমাদের দাঁড় খুঁজে নিই (পোষা পাখির মতো)। অথবা এই একগুঁয়ে রক্ষণশীলতার সম্পর্কে (প্যাসকাল ব্রুকনারের ভাষায় যাকে বলে-“পাশ্চাত্য জীবন পদ্ধতি নন-নেগোশিয়েবল) দরকষাকষি করা যাবে না।” আমি সেখানেই থেমে যাই নি। আমি অন্যকিছু চাই। তাই আমার কাছে আমার পিতার সেই সূত্রের প্রতি ভক্তি আছে।
যুদ্ধের পর আপনার এক শিক্ষক আপনাকে থিয়েটারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার মুখোমুখি হওয়াটা কেন এত ডিসাইসিভ? এটা কিভাবে আপনার জীবনের দিক নির্দেশনা হলো?
আমি যখন পড়তাম সেসময় হাইস্কুল শুরুর সাথে সাথে সবাই রেকিন, কর্নেই এবং মলিয়ের দিয়ে শুরু করতো। পছন্দ হোক বা না হোক আমাদেরকে প্রিমিয়ার ক্লাস পর্যন্ত সেসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হতো। এবং আমরা প্রত্যেক বছরেই তাদের প্রতিটি নাটক একটি করে মঞ্চস্থ করতাম। এটা ছিল একটা পড়াশোনার প্রোগ্রামের অংশ। কিন্তু একটা প্রোগ্রামের চাইতে একজন ব্যাক্তির মুখোমুখি হওয়া সহজ। আর আমার ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছে। যখন আমি কোয়ার্টার ক্লাসে (১৩-১৪ বছর বয়সীদের ক্লাস) তখন আমার একজন ফরাসি শিক্ষক ছিলেন যিনি থিয়েটারকে এমন এক অসাধারণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতেন যে বিষয়টিতে আমরা নিজেরাই অংশ নিতে পারি। কারন তখন আবশ্যকীয় ব্যাপার ছিল নাটক অধ্যয়ন করা নয় বরং তাতে পারফর্ম করা।
তিনি আগ্রহী প্রত্যেককে নিয়ে একটা দল বানালেন। আর আমিও ধীরে ধীরে অন্যদের সাথে মিলে অভিনেতা হয়ে গেলাম। কী অনন্য ঘটনা ছিল সেটা! আমার স্কুলপড়ুয়া সাধারণ জীবনে একটা ছেদ পড়ল। আমরা দর্শকদের সামনে মঞ্চে উঠলাম এবং মঞ্চে যা ঘটতে যাচ্ছে তার দায়দায়িত্বও আমাদেরই- এমন একটা ব্যাপার। সেই যেমনটা আমার বাবা বলেছিলেন, অর্থাৎ- আমাদেরকে তা চাইতে হয়েছিল।
আমি ‘স্কেপিনের ছলাকলা’ (Les Fourberies de Scapin) নাটকের নামচরিত্রে অভিনয় করি। এটা আমার জন্য ছিল ট্রিক করা আর বুদ্ধিদীপ্ত ডায়লগ দেয়ার প্রশিক্ষণ। আমার এখনো মনে আছে যে, কাঁপতে কাঁপতে আমি মঞ্চের আলোতে অভিনয় শুরু করি এবং প্রথম ডায়লগটি দেই-‘এইটা কি, মিস্টার অক্টাভ? ব্যাপারটা কি? এইটা কি? তোমার সমস্যা কি?’ এই ডায়লগ মঞ্চ থেকে একদল অপরিচিত দর্শকের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েছিলাম আমি। আর থিয়েটার করতে হলে আপনাকে তা চাইতে হবে, এবং স্পটলাইটে থাকার মত কাঠিন অবস্থা পার হয়ে নিজের সন্ত্রস্ততা নিয়ে সবার সামনে একা মঞ্চে দাঁড়াতে হবে। আপনার সন্ত্রস্ততা আপনি যে ঝুঁকি নিচ্ছেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে।
নিজেকে এবং পৃথিবী যেমন আছে তাকে সংরক্ষণ করার জন্য মানুষের যে বৈশিষ্ট্য- তেমন কোন সাবজেক্টিভ রক্ষণবাদীতা কি আছে?
হ্যা, মানুষের মধ্যে তীব্রভাবে রক্ষণশীল কিছু একটা আছে আর এটা স্বয়ং জীবন থেকেই আসে। যেকোন কিছুর আগে, আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আপনার নিজেকে রক্ষা করতে হবে, যেমনটা স্পিনোজা লিখেছেন যে, নিজের অস্তিত্বের সাথে লেগে থাকার জন্য তা দরকার। যখন আমার বাবা আমাকে বললেন যে ইচ্ছাই (will) যথেষ্ট হতে পারে তখন তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন যে, কখনো কখনো তোমার ভিতরের এই সংরক্ষণশীল বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম/উপেক্ষা করতে হবে।
থিয়েটার এমন একটা মুহুর্ত যেখানে একটা জীবন্ত দেহ একট কল্পনার জন্য খাটে। সেখানে, মানুষের টিকে থাকার বিশুদ্ধ এবং সাধারণ তাড়নার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু একটা চলে আসে। অভিনেতার অভিনয়ের মধ্যে আপনার নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মোচন করার ঝুঁকি নেয়ার মত অতিপ্রাকৃতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে। আমার সেই ফরাসি কোয়ার্টার ক্লাসের শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা যে আমি এসবের মুখোমুখি হয়েছিলাম। থিয়েটার আমার প্রথম পেশা এবং আমি সবসময় এর কাছে ফিরে যাই।
তার মানে আপনি থিয়েটারেই সিদ্ধান্ত এবং খোদ মুখোমুখি হওয়া দুটিরই মুখোমুখি হয়েছিলেন...
সবচে গুরুত্বপূর্ণভাবে আমি একজনের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তিনি আমার সেই ফরাসি শিক্ষক। তিনি ছিলেন আমার থিয়েটারের মুখোমুখি হওয়ার জীবন্ত সমাধান। আর হুবহু এটাই প্লেটো তার সিম্পোজিয়ামে ব্যাখ্যা করেছেন। যেখানে তিনি ব্যাখ্যা দেন যে, ফিলসফি নিজেই কারো সাথে মুখোমুখি হওয়ার উপর নির্ভর করে। আর এটাই সক্রেটিসের সাথে আলসিবিয়েদস’র মুখোমুখি হওয়ার চমৎকার বর্ণনার মানে। আর কারো সাথে এই ধরণের মুখোমুখি হওয়ার মধ্য দিয়েই ‘ইচ্ছা’, ‘সিদ্ধান্ত’, ‘নিজেকে উন্মোচন’ এবং অপরের সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এসব কিছু আপনাকে দুর্দান্ত ভয়ংকর এবং মৌলিক অবস্থায় ফেলবে।
আপনার অপর বোঝাপড়া ছিল দর্শন এবং জাঁ পল সার্ত্রে পাঠ। আপনি দর্শনকে কেন জীবনের অভিমুখ হিসেবে ঠিক করলেন?
সার্ত্রের মাধ্যমে আমি যে দর্শনের মুখোমুখি হয়েছি তা আমার বাবার সেই সূত্রের বর্ধিতাংশ। একটি আবশ্যকীয় বিষয়ে আমি সার্ত্রের ভক্ত। তার মত হল- কিছুই না করার জন্য যুক্তি হিসেবে আপনি বিদ্যমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে পারেন না। এটা তার দর্শনের মূল পয়েন্ট যে- পরিস্থিতি [কখনো] না চাওয়া, সিদ্ধান্ত না নেওয়া এবং কিছু না করাকে জায়েজ করে না। সার্ত্রের মতে এটি স্বাধীন সচেতনতা আর একমাত্র এটিই কোন পরিস্থিতির অর্থ প্রদান করে। অতএব পরিস্থিতি যাই হোক আপনার নিজের দায়িত্ব থেকে পালানোর কোন সুযোগ নেই। এমনকি পরিস্থিতি যদি আপনার ইচ্ছা যা চায় তা অসম্ভব মনে হলেও আপনার সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন চাইতে হবে। এটাই সার্ত্রের সবক।
সুখী হওয়ার জন্য দর্শন আমাদের কি কাজে লাগতে পারে?
আপনি নিজে জানতেন না যে আপনি কোন বিষয়ে সক্ষম এবং সে বিষয়ে আপনি সক্ষম তা আবিষ্কার করলে যা ঘটে তাই হচ্ছে সুখ। যেমন- একটা রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনি এমন কিছু আবিষ্কার করেন যা আপনার মৌলিক রক্ষণশীল স্বার্থপরতাকে মুশকিলে ফেলে। আপনি তখন মেনে নেন যে, আপনার অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে আরেকজনের উপর নির্ভর করে। এই বিষয়ের অভিজ্ঞতা লাভের পূর্বে এ সম্পর্কে আপনার সামান্যতম ধারণাও ছিল না।
আপনি তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেন যে আপনার নিজের অস্তিত্ব অপরজনের উপর নির্ভরশীল। আর এই অপরজন, যে আপনার অস্তিত্বের অংশ হংয়ে গিয়েছে, আপনার নিজেকে সুরক্ষার জন্য নেয়া সাবধানতাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। এই আদি নতুনত্বের (premordial novelty) সাথে বেঁচে থাকার জন্য আপনাকে তখন এই সুখের পরিণতিগুলোকে আনতে চাইতে হবে। এর শীর্ষ অবস্থানে একে ধরে রাখতে এবং চেষ্টা করতে হবে। অথবা এটাকে পুনরুদ্ধার বা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করতে হবে। কাজেই আপনাকে মেনে নিতে হবে যে, এই সুখ (happiness) মাঝেমাঝে আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে কাজ করে।
সুখ (happiness) এবং আত্মতুষ্টি (satisfaction)কে আপনি পরস্পর বিরোধী হিসেবে হাজির করছেন কেন?
প্রথমত, অপরের প্রশ্নকে সমন্বিত করায় সুখ মৌলিকভাবেই সাম্যময়। অন্যদিকে আত্মতুষ্টি টিকে থাকার স্বার্থপরতার সাথে জড়িত, সমতার কোন ব্যাপার সেখানে নেই। আর আত্মতুষ্টি কোন বোঝাপড়া বা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল নয়। আত্মতুষ্টি আসে তখন যখন আমরা পৃথিবীতে একটি ভাল জায়গা পেয়ে যাই। যেমন- একটা ভাল চাকরি, একটা সুন্দর গাড়ি, বিদেশে চমৎকার একটা ছুটি কাটানোর সুযোগ ইত্যাদি। আত্মতুষ্টি হলো আমরা যা পাওয়ার জন্য লড়াই করি তা ভোগ করার নাম। মোটকথা, আমরা যেমন তেমন পৃথিবীতেই একটি জায়গা খুঁজে পেতে চাই, যাতে আমরা নিখুঁতভাবে এর আনন্দগুলো উপভোগ করতে পারি। ফলে আত্মতুষ্টির ক্ষেত্রে ব্যক্তি খুবই সংকীর্ণ সাবজেক্টিভিটির প্রতীক। সুখের তুলনায় আত্মতুষ্টি হচ্ছে যেমন-তেমন পৃথিবীর নিয়ম অনুসারে একটি সাফল্যের প্রতীক।
স্টয়িকরা বলতে পারে যে, ‘আত্মতুষ্ট হওয়ার মাধ্যমে আত্মতুষ্ট থাকো’। বিষয়টি আমি সহ কম বেশি সবাই অনুসরণ করে এমন একটি সাধারণ অবস্থান। কিন্তু একজন দার্শনিক হিসেবে আমাকে বলতে হবে যে, আমি সুখ বলতে যা বোঝাচ্ছি তা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু। দর্শন সবসময় মানবতাকে এই সত্যিকার সুখের দিকে পরিচালিত করতে চেয়েছে। এমনকি যখন এই সুখ শুধুমাত্র আত্মতুষ্টি ক্ষুণ্ণ করেই পাওয়া সম্ভব।
যদি অসম্ভব মনে হয় এমন শক্তিশালী এবং সৃজনশীল অস্তিত্ব উপভোগ করাই সুখ হয়ে থাকে তাহলে সুখী হওয়ার জন্য পৃথিবীকে বদলানোর দরকার আছে কি?
পৃথিবীর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয় আত্মতুষ্টি এবং অসন্তোষ্টির ভিতরকার দ্বান্ধিকতার মাধ্যমে। মূলত এটা চাহিদার দ্বান্ধিকতা। আমরা এটাকে ‘পৃথিবীর ট্রেড ইউনিয়ন দৃষ্টিভঙ্গি’ বলতে পারি। কিন্তু সত্যিকার সুখ সামাজিক জীবনের একটি ক্যাটেগরি (বর্গ) নয়। যখন আপনি কোন সুখের চাহিদা পোষণ করেন এবং তার উত্তর হয় ‘না’ (নেতিবাচক), তখন আপনার দুটি সম্ভাবনা থাকে। প্রথম সম্ভাবনা হলো আপনার নিজেকে বদলানো এবং সেই অসম্ভব কিছু একটা আর না চাওয়া। আপনি নিজের জন্য সুখ নিষিদ্ধ করেন। আপনি তখন নিজেকে আত্মতুষ্টির সাথে আবদ্ধ করেন। আপনি মেনে নেন। আর এটাই হচ্ছে রক্ষণবাদিতার সাবজেক্টিভ ভিত্তি।
দ্বিতীয়ত, যেটা সম্পর্কে লাকাঁ বলেছেন- নিজের বাসনা ছেড়ে না দেয়া। অথবা যেমন আমার বাবা বলেছিলেন- যা চাই তা চাওয়া বন্ধ না করা। তখন এমন একটা মুহুর্ত আসে যখন আপনার ভিতরের মানবতার রূপটি রক্ষা করার জন্য- সুখকে অসম্ভব হিসেবে মেনে নেয়ার পরিবর্তে আপনার তখন পৃথিবী বদলানোর বাসনা দরকার হয়।
তার মানে আপনি সুখী হলে পৃথিবী বদলাতে পারেন?
হ্যা, তাই। সুখী হওয়ার ধারণার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা এবং সুখ যে আত্মতুষ্টির মত না- সেই সত্যের জন্য প্রতিরোধ তৈরি করা। পৃথিবীর মাতব্বরেরা পরিবর্তন চায় না। কাজেই আপনি যদি স্রোত এবং বাতাসের বিপরীতে যেতে চান, যে অন্য কিছু সম্ভব তাহলে আপনাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তারা তাদের সব উপায়ই ব্যবহার করবে। এটাই বর্তমানে গ্রিসের সমস্যা। গ্রিকরা বলছে যে- ‘আমরা তোমাদের অর্থনৈতিক স্বৈরাচারিতা চাই না। আমরা ভিন্নভাবে থাকতে চাই।’ ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাব হচ্ছে- ‘আমরা যা চাই তোমাদেরকে তাই চাইতে হবে। এমনকি তা তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেও। যদি তোমরা যা চাওনা তা না চাওয়া চালিয়ে যাও, তাহলে তোমাদের কি হবে তা তোমরা টের পাবা।’
স্বেচ্ছায় দাসত্ব মেনে না নিলে লোকজনকে হুমকি পেতে হয়। সুতরাং গ্রিকদের দাবি আত্মতুষ্টি এবং অসন্তোষ্টির দ্বান্ধিকতার মধ্যে থাকা নয়। তারা দেখিয়েছে যে, তাদের উপর যা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার চেয়ে আলাদা। অন্যকিছু হওয়া সম্ভব- এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তারা চায়। আমরা এখানে কোন ইউটোপিয়ার কথা বলছি না। প্রচুর পরিমাণ পুরোপুরি রক্ষণশীল অর্থশাস্ত্রবিদ বলছেন যে আমরা গ্রিসের ঋণকে পুনর্গঠন করতে পারব। যার মানে হচ্ছে ঋণ মুছে ফেলা। এমনকি যদি তারা এমনটি নাও চায়। বাস্তবে, ইউরোপীয় নেতারা জনগণকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেয়াকেই অসম্ভব মনে করছেন। এটি কোন যৌক্তিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ নয়, বরং রাজনৈতিক শাস্তি। এটা হচ্ছে একটি অপূর্ণ আত্মতুষ্টির নামে সুখী হওয়ার বাসনার কারণে শাস্তি।
প্যাসকাল লিখেছেন যে, ‘আমরা কখনো বাঁচি না, বরং বাঁচার আশা করি; আর আমরা যে সবসময় সুখী হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি তাতে এটা অনিবার্য যে আমরা কখনো সুখী হতে পারব না।’ সত্যিকার সুখ মানে কি বেপরোয়া হতেই হবে?
এরকম একটি অশুভ বাগধারা আছে! কিন্তু প্যাসকাল যখন তা লিখেছিলেন তখন তিনি ভাবতেন পরবর্তী জগতে মুক্তি অপেক্ষা করছে। যারাই দর্শনে সুখের অসম্ভব হওয়ার উপর জোর দেন তারা আরেকটি সুখের প্রতিশ্রুতি দেন। তারা জানেন যে, সুখ অসম্ভব হওয়ার প্রমাণ দিয়ে আপনি আপনার পাঠকদেরকে আগ্রহী করতে পারবেন না। কাজেই তারা তাদের টুপির ভেতর থেকে এক সর্বব্যাপী সুখ বের করে আনেন।আমি সবসময়ই এই কথার চরমবিরোধী যে, এমন সুখ আছে যার স্বপ্ন আমরা সব সময় দেখি অথচ সেখানে পৌছানো সম্ভব নয়। এটি ভুল। সুখ অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু রক্ষণশীলদের আত্মতুষ্টি আকারে নয়। এটি এই শর্তে সম্ভব যে, আমরা আমাদের বোঝাপড়া এবং সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিই। চুড়ান্তভাবে প্রত্যেক মানুষের জীবনই কোন না কোন সময়ে এরকম বাছাইয়ের মুখোমুখি হয়।
কিন্তু বিভিন্ন অসুখ যেমন- অসুস্থতা, জীবনের দুর্ঘটনা, নাটকীয়তা, সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া এবং ঝগড়াঝাটিসুলভ বিচ্ছেদ- এসব সম্পর্কে কি বলবেন?
আত্মতুষ্টি এবং সুখ আলাদা হওয়ার সত্যটি ‘অসুখ’ শব্দটার মধ্যেই একটা বিভাজন দাবি করে। এমন অসুখ আছে যা মূলত গভীর অসন্তোষ্টির বেশি কিছু নয়। কিন্তু, সম্ভাব্য পরিবর্তনের অবস্থান এবং গুরুত্বের কারনে চরম ধ্বংসাত্মক অবস্থায়ও সুখের রাস্তা খুব কমই বন্ধ হয়। দুটি সুস্থ পা-অলা কারো জন্য তিন কদম হাটা তেমন কিছুই নয়। কিন্তু অবশ (প্যারালাইজড) ব্যক্তির জন্য ব্যাপারটা ঠিক সুস্থতায় পৌছানো, তীব্র আনন্দের ব্যাপার। কাজেই আমাদের কখনো বলা উচিত হবে না যে, সুখ মুছে গেছে। বরং এর অস্তিত্ব আছে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় সম্ভব অসম্ভবের মধ্যেকার সীমা বদলায়। অনেক অনেক বিমূর্ত এবং সাধারণত অসম্ভব বিষয় দিয়ে নিজেকে ভারাক্রান্ত করা সুখ নয়।
তাহলে অসুখ কি?
আমরা প্রথমত অসুখকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি একটি গভীর অসন্তোষ্টি এবং অসম্ভবের চরম বিস্তৃতিকরণের অবস্থা দিয়ে। কিন্তু অসুখ আবার সুখের ব্যর্থতাও হতে পারে। ভক্তির যে নীতির কথা আমি উপস্থাপন করলাম- যেটা আবার বোঝাপড়া এবং একইভাবে সুখের সাথে সম্পৃক্ত- সেটা হলো সবসময় সুখ খোঁজা একটি আবশ্যকীয় ব্যাপার (ইম্পারেটিভ)। ভক্তি শুধুমাত্র নৈতিকভাবে আবশ্যক। কিন্তু এই আবশ্যকীয়তা সব ধরণের ঝুঁকির বিরুদ্ধে ইন্সুরেন্স/বীমা নয়।
আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে, সুখ দুর্যোগের দিকেও ধাবিত হয়। এই দুর্যোগ বিভিন্ন রকমের। কিছু কিছু দুর্যোগ ক্লান্তি এবং আত্মসমর্পণের ফলে ঘটে, আর অন্যগুলো ঘটে ভক্তিহীনতা এবং বিশ্বাসঘাতকার কারনে। আমার দর্শনে সুখের ক্ষেত্রে দুর্যোগের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হওয়ার ঘটনাই মন্দ। আমি এটাকে বলি বিপর্যয়। এই অভিজ্ঞতা সুখের অভিজ্ঞতা তীব্র হওয়ার মতই ভয়ংকর। রক্ষণশীলরা খুবই বিপর্যয় পছন্দ করে। কারন বিপর্যয় থেকেই তারা আত্মতুষ্টির পক্ষে তাদের প্রধান যু্ক্তিটি খুঁজে পায়।
কিন্তু আপনি তো বলেন ‘সত্তাহীনতার (unbeing) চেয়ে বিপর্যয় শ্রেয়’...
হুমম, তাই। নিজেকে নিষেধ করার চেয়ে বিপর্যয়ের ঝুঁকি নেয়া শ্রেয়। কারন তাতে সত্যিকার সুখের চান্স আছে। আর সত্তাহীনতা বলতে আমি বুঝাচ্ছি মানুষের (সাবজেক্ট) রক্ষণশীলতার সেই সহজাত বৈশিষ্ট্যকে যা তাকে তার পাশবিক অস্তিত্বের দিকে টেনে নেয়, শুধুমাত্র আত্মতুষ্টি এবং সমাজে তার অবস্থানের দিকে তাকে টেনে ধরে। মানুষ যা সত্যিকারভাবে করতে সক্ষম তা আবিষ্কার করতে বাধা দেয় যে- সেটাই সত্তাহীনতা।
প্রেম এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক কি এই তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণের আত্মতুষ্টির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়?
বর্তমান পৃথিবীতে পরিবর্তন এবং আদানপ্রদানের একটি মৌলিক মডেল আছে। একে বলে বাণিজ্যিক তথা কমার্শ্যল প্যারাডিম। আমরা অপরের সাথে আমাদের সব সম্পর্ককে স্বীকৃত পারস্পরিক স্বার্থের একটা চুক্তির মাপে সংকীর্ণ করে ফেলেছি। একারণে আগের চাইতে বিচ্ছেদের হুমকিটা বেশি। কোন পণ্যের মডেল অচল হওয়া সহ কোন কিছু অচল হয়ে গেছে এমন একটা অকালপক্ক অনুভূতিতে আমরা খুব তাড়াতাড়ি পৌছাই।
ভোক্তা হচ্ছে এমন প্রভাবশালী কর্মরূপ (অবজেক্টিভ) যেটা পৃথিবীকে ঘুরিয়ে দেয়। আমাদের মোড়লেরা জনগণের পণ্য ক্রয়ের স্তর উদ্বিগ্ন হয়ে অনুসরণ করে। উদাহরণস্বরূপ যদি হঠাৎ করে কেউ কিছু না কিনে, তাহলে পুরো ব্যাবস্থাটা স্কিটলের সারির (স্কিটল এক ধরণের খেলা এবং সে খেলায় ব্যবহৃত কাঠের বোতল) মতো ভেঙ্গে পড়বে। কাজেই আমরা বিভিন্ন জিনিষ বের হলেই নতুনত্ব সহ এবং পুরোপুরি অকার্যকরতা ও অপরাধী কদর্যতা সহই তা কেনার জন্য শৃংখ্যলিত হয়ে আছি। আর আমি মনে করি এটা মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের -যে সম্পর্কে মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্য দেয়ার চেষ্টা ছিল- সাধারণ ধরণটাকে দূষিত করবেই।
আপনি কি তবে ভক্তির বন্দনা করবেন?
এক অর্থে। কারন, আনকোরা নতুন-পণ্য, যেটা অধিকাংশ সময়ই ফ্যাশনের আড়ালে হাজির হয়, এমন একটা প্রবণতা যা আমাদের সুখের বিরুদ্ধে বড় ধরণের আঘাত হানে। সুখের সবরকম ক্ষেত্রেই আঘাত হানে। আর ভক্তি নামক মূল্যবোধ এক্ষেত্রে হুমকির মুখে। আমাদের গাড়ির প্রতি অনির্দিষ্টকাল ধরে ভক্তি রাখার অধিকার আমাদের নেই; ফলে আমাদেরকে নতুন গাড়ি কিনতে হবে। নয়তো অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা হুমকির মুখে পড়বে!
এই আবশ্যকীয়তাই আমাদের ব্যক্তিগত বা যৌথ পৃথিবীতে আনাগোনা করে এবং অনেক অনেক বিচ্ছেদ তৈরি করে। এই যু্ক্তির বিরুদ্ধে আমাদেরকে আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া সেই সুত্র সামনে তুলে ধরতে হবে। “তুমি যা বাসনা করেছ তা চাওয়া চালিয়ে যেতে পারো; যেটা তুমি চেয়েছিলে, এবং তুমি জান যে তুমি তাতে সক্ষম। তুমি পারো অতএব তুমি অবশ্যই বাসনা করবে।”
____________
No comments:
Post a Comment