Friday, June 9, 2017

চিকিৎসা ব্যবস্থার রোগ - ১

গুরুদেবই ভরসা। তারে দিয়াই শুরু করি।
“বৈজ্ঞানিক নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা মানুষের পক্ষে কত স্বাভাবিক আমরা প্রতিদিনই তাহার প্রমাণ পাই। যে ডাক্তার নিপুণ চিকিৎসার দ্বারা অনেক রোগীর আরোগ্য করিয়া থাকেন, তাঁহার সম্বন্ধে আমরা বলি লোকটার হাতযশ আছে। শাস্ত্রসংগত চিকিৎসার নিয়মে ডাক্তার রোগ আরাম করিতেছে এ কথায় আমাদের আন্তরিক তৃপ্তি নাই; উহার মধ্যে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমস্বরূপ একটা রহস্য আরোপ করিয়া তবে আমরা সন্তুষ্ট থাকি। [....] শাস্ত্রসংগত চিকিৎসার কাছে আমরা অধিক আশা করিতে পারি না–এমন রোগ আছে যাহা চিকিৎসার অসাধ্য; কিন্তু এপর্যন্ত হাতযশ-নামক একটা রহস্যময় ব্যাপারের ঠিক সীমানির্ণয় হয় নাই; এইজন্য সে আমাদের আশাকে কল্পনাকে কোথাও কঠিন বাধা দেয় না।” (রবীন্দ্রনাথ/ বৈজ্ঞানিক কৌতূহল)

চিকিৎসা যে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা প্রসূত এক জরুরি কাণ্ড- এই কাণ্ডজ্ঞান জাতির হয় নাই। হাতযশ বলিলে কোন কোন ডাক্তারেরও হয়তো একটু আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা নিবারন হয়, তবে তাতে বাঙালির বুদ্ধির চোখ ঠুলি হইতে নিরাবরন হয় না।

রোগটা কি আর তার চিকিৎসা কি দেয়া হইতেছে- এইটা ডাক্তারগণ বুঝাইয়া দেন না। এমন অভিযোগ আছে। একই সাথে রোগীর সেই প্রকার ধৈর্য আগ্রহ (কিংবা ক্ষমতা) তৈরি হয় নাই- সেকথাও মনে রাখা জরুরি। রোগ বেরাম সম্পর্কে শুনবার আর তা বুঝবার কান-মাথার অভাব আছে বটে। এই অভাবের তাড়নায় আর হাতযশ ইত্যাদি বিশ্বাসের কারনে রোগীরা নিজেদের রোগের চাইতে ডাক্তার সম্পর্কে বেশি আগ্রহী হইয়া ওঠেন। মাঝে মাঝে উহা অসদাচারনেও গড়ায়।
...
ডাক্তারি সেবাটা বাজারে বিক্রি হয়। আপনি সেবা ক্রয় করুন। বুঝিয়া নেন। ডাক্তারের হাতযশ নাম ধামের উপর পুরাপুরি ছাড়িয়া দিলে চলে না। সম্পর্কটাকে পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে বুঝুন।

ডাক্তাররাও তাই করিবেন। রোগী কিন্তু করুনা খরিদ করিতেছে না। পয়সা খরচ করিয়া সেবা নিতে আসিয়াছে। সেবাটা বাজারি না মনে হইলেও ইহা বাজারি ব্যাপার বটে। আর বাজার চলে কম্পিটিশনে। ভাল সেবা কম দামে দেয়ার কম্পিটিশন। কাজেই একচেটিয়া বা সিন্ডিকেট নির্ভর বাজার জুলুম। এই জুলুম অবিচার জগতে মারামারির উর্বর জননী।
...
এই রোগেরই আরেক ধারার লক্ষণ হইল- শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা। বাঙালি শিক্ষকদের উপর মহত্ব আরোপ করার মাধ্যমে নিজের শিক্ষা ও খোঁজ খবর নেয়ার দায় হইতে মুক্তি লাভ করে। আর ভাবে মহান শিক্ষক মাহাত্ম্ দিয়া মগজ ও চরিত্রের রোগ ব্যারাম এক পলকেই সারিয়া ফেলিব। আহা, আফসোস। সে যে হয় না। সে যে হয় না।

শিক্ষক প্রাণীটাও মানুষ প্রজাতির মধ্যকার। মানুষের সীমানা লইয়াই সে থাকে। তার অসীম অলৌকিক ক্ষমতা কিংবা মাহাত্ম নাই।

টাকা পয়সা অাত্মীয় স্বজন আশা আকাংখা দ্বারা প্রভাবিত হইয়াই উহারা জমিনে বিচরণ করেন।

কাজেই অনেক ক্ষেত্রেই স্কুলে গিয়া খোঁজ লইতে হইতে পারে শিক্ষা কেমন চলিতেছে। চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার সুযোগ নাই।
...
মহৎ মানুষেরা যেকোন পেশায় কিংবা পেশাহীনও থাকিতে পারেন। মহত্ব দক্ষতা পেশায় নাম লেখাইলেই নাজিল হয় না।

মহত্বের উপর নির্ভর না করে বাজার কি জিনিষ তা বুঝার চেষ্টা করেন। বাজারকে নাক সিঁটকাইয়া কিংবা সাম্রাজ্যবাদ হেনতেন বলিয়া গালি দিয়া উদ্ধার পাওয়ার উপায় নাই।
...
পুনশ্চ: বাজার না বুঝলে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে লা’নত আর অভিশম্পাত দিয়া আসন্ন রোজায় উচ্চমূল্যের চাপে পড়িবেন। সমস্যার সমাধান করিতে পারিবেন না; মূল্য না বুঝিয়া বোধের চর্চা করিবেন। আর বাজার গ্রহে লুটপাটতন্ত্রের স্বাদ নিবেন।

(২৪.৫.২০১৭- খসড়া কথা। আরো ভাবিয়া আরো বলিতে হইবে।)

No comments:

Post a Comment

Delulu and Danger of Innocence of Law

The persistent political crisis in Bangladesh is often framed as a binary dilemma: is the nation suffering from a flawed political culture, ...