Wednesday, August 14, 2024

রিমান্ডকেই আমরা যেন বিচার এবং শাস্তি মনে না করি

রিমান্ড বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সবচে অপব্যবহার হওয়া একটা প্রক্রিয়া। যদিও এর আইনগত অর্থ আর ব্যবহারিক অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। অটোক্রেটিক শাসন সবচে বেশি যেই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে মানুষের আইনগত, সাংবিধানিক, এবং মানবিক অধিকারকে অস্বীকার করেছে তার একটি হচ্ছে রিমান্ড।
এই ব্যবস্থা একই সাথে বাংলাদেশের পুলিশ ব্যবস্থাকেও অন্যায্য ও বেআইনি আচরণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
আমরা আসলেই পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কার চাই কিনা তা পরীক্ষার সময় তৈরি হয়েছে। এই পরীক্ষায় পাশ করলেই বোঝা যাবে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের সঠিক রাস্তায় এগুচ্ছি। সত্যিকার অর্থেই আমরা অটোক্রেসির বিচারিক এবং প্রশাসনিক যন্ত্রপাতি ও প্রক্রিয়ার বাতিল করতে চাই কিনা। এবং অভিযুক্ত এমনকি অপরাধীসহ সকলের প্রাপ্য মানবাধিকার নিশ্চিত করতে চাই কিনা।
জনাব সালমান এফ রহমান এবং জনাব আনিসুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ডিবি পুলিশের পেশ করা দশ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। আদালতে তাদের কোন আইনজীবী ছিলেন না; এমনকি কোন পাবলিক প্রসিকিউটরও এপিয়ার করেন নি। যে মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে সে মামলার বাদী আদালতে উপস্থিত হয়ে হত্যা মামলার বিচার চেয়েছেন।
এই ঘটনাকে ঘিরে কয়েকটি বিষয় নোট করে রাখছি।
১. ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হলে রিমান্ডে নিয়ে কাউকে নির্যাতন করা যাবেনা। বাংলাদেশ ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার (UNCAT) এর একটি পক্ষ। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানেও এ সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা রয়েছে। এছাড়া এসবের বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ কার্যকর রয়েছে বাংলাদেশে।
এসব রাষ্ট্রীয় দায়, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার, এবং আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে একটি অটোক্রেটিক শাসন তৈরি করা এবং টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশে এমন নাগরিক খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি মনে করেন রিমান্ডে নির্যাতন করা হয় না। রিমান্ড মানেই মানুষের কাছে এক ভয়ংকর পুলিশি নিপীড়নের নাম। আমাদের পুলিশ ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা এবং ভালবাসা নষ্ট করার একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে রিমান্ড। যদিও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোন নিপীড়ন হয়নি এই বিশ্বাস তৈরি করতে হবে।
তা তৈরির জন্য প্রথমত বিদ্যমান আইন (আদালতের নির্দেশনাসহ) মেনে চলতে হবে। আদালতের একটি দায়িত্ব রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করার পর আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে মর্মে বিশ্বাস করার কোন কারন থাকে, তবে আদালত দণ্ডবিধির ২২০ ধারার অধীনে তদন্তকারী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। (বাংলাদেশ বনাম ব্লাস্ট, ২০২৬)।
এমন আরো বিভিন্ন আইনি প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়াকে আইনানুযায়ী পরিচালনারা জন্য এসব প্রতিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। নয়তো বিচার ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থা বাড়ানো কঠিন হবে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রিমান্ডকেই আমরা যেন বিচার এবং শাস্তি মনে না করি। রিমান্ডসহ কোন অবস্থাতেই নির্যাতন যেমন আইনসম্মত নয়, তেমনি রিমান্ডও বিচার নয়। বরং জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়ার একটি প্রাথমিক ধাপ।
২. এক্ষেত্রে যে চর্চা রিমান্ডের ক্ষেত্রে শুরু করা যায় তা হচ্ছে - সচ্ছতার জন্য রিমান্ডে/ পুলিশের হেফাজতে থাকার সময়েও আইনজীবী এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ ও সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে। আরো ভাল হবে যদি আইনজীবী দেখতে পান - হতে পারে মিউটেড ভিডিওর মাধ্যমে - এমন পরিবেশেই কেবল জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। এতে পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্যের সাক্ষ্যগত মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যদিও বর্তমানে সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. এছাড়া গ্রেফতার হওয়া সকলের ক্ষেত্রেই আদালতের শুনানির সময় আইনজীবী রাখতে হবে। যদি কোন আসামীর আইনজীবী না থাকে তবে তার জন্য সরকারি আইনসহায়তার জন্য তালিকাভূক্ত কোন আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। আদালত অন্তত সেই সুযোগটুকু যেন গ্রেফতার হওয়া সকলকেই দেন।
৪. আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জনাব সালমান এফ রহমান এবং জনাব আনিসুল হককে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গিয়েছে। তাদেরকে বেঁধে রাখার প্রয়োজনীয়তা সেসময় ছিল কিনা তার ব্যাখ্যা যারা গ্রেফতার করেছেন তারা দিতে পারবেন। কিন্তু আমরা চাইনা কোন আসামীকেই এভাবে বেধে ছবি তোলা হোক। ছবি তুলে সেই ছবি সংবাদ মাধ্যমে শেয়ার করা একটি বেআইনি কাজ। এসব চটকদার কাজ থেকে বিচার প্রক্রিয়াকে দূরে রাখা আইন-শৃংখ্যলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাংবাদিক সকলের জন্য জরুরি।
৫. জুলাই ম্যাসাকার এবং পরবর্তী গণ অভ্যুত্থানের ফলে সারা দেশে অনেক মামলা হয়েছে, হচ্ছে, আরো হবে। শুরুর দিকে যেসব মামলা সরকারি উদ্যোগে হয়েছিল সেগুলোতে নিহতদের তথ্য নেই - এমন খবর পত্রিকায় দেখেছি আমরা; বেশিরভাগ এজাহার গতবাধা রাজনৈতিক বর্ণনায় তৈরি ছিল। দুর্বল কিংবা ভুল মামলায় আসামী করার মাধ্যমে বিচারকে নষ্ট করা যেন না হয়। ভুক্তভোগী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এবং সংবাদ মাধ্যম সহ অন্যরা সত্য তথ্য দেয়ার মাধ্যমে অভিযোগ দিতে পারেন। যাতে করে অপরাধ অনুযায়ী প্রাপ্য শাস্তি দেয়া যায়। এবং তা আমাদের আদালতের মাধ্যমেই। যদি সত্য অপরাধের জন্য তথ্য প্রমাণের ভিত্তি বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো - যেমন জুডিশিয়ারি - শক্তিশালীতো হবেই; রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে।
/১৪ অগাস্ট ২০২৪

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International License.

No comments:

Post a Comment

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়...