Monday, November 15, 2021

পীড়িত পিরিত

১.
ঝিম ধরা শীতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া মগজ আমার
বিভিন্ন ভয় কিংবা দুঃস্বপ্ন আঁকতে আঁকতে বিহ্বল হয়
ঘুম কিংবা স্বপ্ন দেখার জন্য আমার চোখেরা বন্ধ হয়ে থাকে
বন্ধ হয়ে থাকে মগজের কিছু কিছু ঘর
বাইরে কিংবা জানালায় সেসব মুহুর্তের আগে কিংবা পরে
দুনিয়া গুমট করে দেয়া এইসব মেঘলা দিনে
সূর্য হারিয়ে যায় প্রায়ই
মাঝে মাঝে কয়েকদিন থাকে পলাতক
যেন অনিশ্চিত আর সে আসবে কি না কো-ন-দি-ন

এই অবসাদভরা ঘুমের ভেতর স্বপ্ন হয়ে
তুমি ফিরে এলে

যে আমি অনেক কিছুই বলি না তোমাকে, চুপ করে থাকি শুধু ভিতরে ভিতরে ভাঙতে থাকি
সে আমি থামাতে পারি না আমাকে
স্বপ্নে আমি কথা কয়ে উঠি
– বহু জড়তা এবং ভোতা হয়ে যাওয়া পেন্সিলের স্বরে – বলি

ভালবাসি ..
সত্যিই,
এখনো অনেক ..
 
ভালবাসি ...

২.
হয়তো ভালবাসা কঠিন নয়
কত কত মানুষকেই পথে পথে ভালবাসলাম
কত কত পোকা
ঝড়ে ছিঁড়ে যাওয়া লতা
শিশিরে ঝরে পড়া ফুল
ঘাসে ঝুলে থাকা শিশিরবিন্দু
অদেখা কোন গায়কের কোন এক গানের একটি বিশেষ শব্দে কেঁপে ওঠা স্বর
সমুদ্র সাঁতরে বেড়ানো তিমি
আমাদের খেলনা সাইকেল
গোলাপ রঙের অলৌকিক খরগোশ
এবং
মানুষের হাতে খেলনা হয়ে যাওয়া মানুষকে

বিভিন্ন ক্ষণে মনে হয়েছে ভালবেসেছি ..

তবে যতটা কঠিন ভালবাসতে শুরু করা
তারচেয়ে কঠিন নিরন্তর ভালবেসে যাওয়া
আমাদের নাজুকতা, অস্থিরতা, আর মানুষ হবার সীমানায় –
যতটা যত্ন বুদ্ধি প্রজ্ঞা দরকার হয় ভালবেসে যেতে
সে পথ বহুগুন কঠিন সাধনার;

তবু সাধক হওয়ার সাধ আমার নিজের অক্ষমতাকে অস্বীকার করে,
দুঃসাহসী হই - 
ভালবাসি,
তোমাকে,

Wednesday, November 10, 2021

অনাগত

এক‌দিন থাকবেনা কেউ

প‌রি‌চিত কু‌টিল যারা
‌কিংবা অপ‌রি‌চিত শুভাকাংখী
এবং এইসব আমিরা

যারা সর্বদা নিরীহ নিরপেক্ষ নির্দোষ



/এপ্রিল ৪, ২০১৯


Sunday, October 3, 2021

টাইপিং: অভ্র ও বিজয়

গতমাসে বাংলা ভাষার জাতীয় কিবোর্ড (লে আউট) চিনতে পারলাম। এতদিন যে বিজয় কিবোর্ড ব্যবহার করেছি তার চেয়ে ৩-৪টি কি আলাদা। বাকি সব একই রকম। জনাব মোস্তাফা জব্বারের বিজয় লেআউট শুরুর দিকের কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। এটি তাঁর সাফল্য। বাংলা ভাষার জন্য তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ।

অবশ্য তার অবদান বাংলা ভাষার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিনা সেটা হয়তো বিজয় প্রস্তুত এবং বাজারজাতকারী কম্পানি হিসাব করে না। শুনেছি বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি অফিসে বিজয় (পুরনো কোডিং এবং লেআউট) ব্যবহার করা ম্যান্ডাটরি করা হয়েছিল; এমনটা কোন বিচারে করা হয়েছে তা জানিনা। তাছাড়া যদি ম্যান্ডাটরি করতেই হয়, তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় লে আউট রেখে বিজয় কেন ম্যান্ডাটরি হবে?

যাহোক, বর্তমানে টাইপিংয়ে অন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা বিজয় কিবোর্ডের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব না। যেমন কিছু রিসেন্ট সফটওয়ারে বিজয় দিয়ে লেখা যায় না। কারন বিজয়ের কোডিং পুরনো আমলের; প্রায় অপ্রচলিত।

এই লম্বা ভূমিকা বললাম আরেকটি বিষয় জানানোর জন্য। অভ্রর জনপ্রিয়তা থেকে অনুমান করা যায় যে, অভ্র বাংলা টাইপের বড় উপকার করেছে। বাংলা লেখাকে সহজ করে দিয়েছে তার ফোনেটিক লেআউটের মাধ্যমে। তাতে লোকেরা অভ্র দিয়ে লিখতে পারেন খুব সহজে।

বিজয়ের মামলা বা হয়রানির পর অভ্র আর বিজয় লে আউট ব্যবহার করে না। তবে তাদের সফটওয়ারে বাংলাদেশের জাতীয় লে আউট রয়েছে। বিজয়ের লেআউটের সাথে জাতীয় (ন্যাশনাল) লেআউটের পার্থক্য মাত্র ৩-৪টি কি।
 
অভ্র তাদের সাম্প্রতিক ভার্সনে একটি অসাধারণ কাজ করেছে। আপনি একটি কিবোর্ড লেআউট নিজের মত করে তৈরি করে নিতে পারবেন। যে লেআউটগুলো আছে তাকে সামান্য মডিফাই করে কাজটি করতে পারবেন।

আমি প্রথমে বিজয় লেআউটে টাইপ করা শিখেছি। তাই বিজয় লেআউটে লিখতে অভ্যস্ত। গতবছর একটা সফটওয়্যারে বিজয় কাজ করছিল না। সেই সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য খুঁজতে খুঁজতে গত মাসে এই চমৎকার সমাধান আবিষ্কার করলাম।

সপ্তাহখানে কষ্ট করে ৩-৪টি কি শিখে নিলে জাতীয় লেআউট শেখা হয়ে যাবে। যদিও বহুদিনের অভ্যাস আনলার্ন করা কঠিন। এছাড়া সামান্য মডিফাই করে জাতীয় লেআউটকে বিজয়ের মত বানানো যাবে। (৫ থেকে ১০ মিনিটের কাজ। এক্সপার্ট হলে আরো কম সময় লাগবে।)

অভ্র টপবারে সেটিংস থেকে কিবোর্ড লেআউট এডিটর অপশন ব্যবহার করে কাজটি করতে হবে। এবং বিজয় শুধুমাত্র পুরাতন ডকুমেন্ট পড়ার জন্য ব্যাকআপ হিসেবে থাকবে।

(ইংরেজি QWERTY লেআউট নিয়ে এমন জটিলতা নেই। এর সম্ভাব্য কারন হয়তো আমাদের বাংলা ছাপাখানার চেয়ে বাংলা টাইপিংয়ের কয়েকশ বছরের ধীর গতি। যেহেতু বলপয়েন্ট আবিষ্কার না হলে আমাদের অনেকেই আজো কলম দেখতে পেতাম না, তাই টাইপরাইটার দেখা দুর্লভ ব্যাপার; টাইপরাইটারে লেখা আরো দুর্লভ। অবশ্য এসব জিইয়ে রাখা ব্যারাম কিনা আমি জানিনা।)

দারিদ্র্য ও চৈতন্য

অমর্ত্য ইউনুস আবেদের ভাষায় যে আর্থিক জীবনের নাম দারিদ্র্য তা বুঝতে বুঝতে আমার জীবনের অনেকগুরুত্বপূর্ণ সময় পার হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হয় দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতায় সৎ মানুষের মনে অর্থের আকাঙ্খা জন্মায় না। অন্তত বাঙালি মোসলমানের সৎ-অসৎ বিচারের যে মানদণ্ড তাতে দারিদ্র্যের দোর্দণ্ড প্রতাপ। আমাদের সততা দারিদ্র্যের সাথে সমার্থক হয়ে যাওয়াটাই আমাদের চেতনা ও মূল্যবোধের ঘরে বড় ধরনের কেলেংকারি। আমাদের অর্থের আকাংখ্যা তাই হয়ে ওঠে অসৎ, প্রাচুর্য মাত্রই হয়ে উঠে অসুখ এবং অভিসম্পাৎ, আর দারিদ্র্য হয় মহৎ।

(চৈতন্যের এই গোঁজামিল বুঝতে পারার পরেও কাটিয়ে উঠতে পারার ক্ষমতা সকলের হয় না। অনেকেই এই দ্বিধা কাটাতেই পারে না।)

দারিদ্র্য মোকাবেলার যেসব উদ্যোগ আমাদের আছে, সেখানে এই অর্থবিত্ত সম্পর্কিত চেতনা পরিবর্তনের কৌশল সম্ভবত থাকে না। পুঁজিবাদী কৌশলের সাথে বাংলার দারিদ্র্য মোকাবেলার চিন্তা – দান-খয়রাত-সওয়াব ও পরকালের মধ্যে একত্রিত হয়েছে। সম্ভবত পশ্চিমে পুঁজির সাথে সমাজের এবং চেতনার যে সম্পর্ক সেখানে এই ধরনের কেলেংকারি নেই।

অর্থকে সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে যদি সমাজে বিবেচনা করা হয়, তবে সেই মানদণ্ড সম্পর্কে স্পষ্টতা রাখতে হবে। তাকে যত ট্রান্সফারেন্ট রাখা যায় ততই কল্যান। তাকে মানদণ্ড না মানার অজুহাতে দারিদ্র্যর মত অবিচারকে টিকিয়ে রাখা বা উপেক্ষা করা আরো ভয়ানক শয়তানি।

সম্পদ জমানো, সম্পদ গড়া – পুঁজির বিচারে এসব সমস্যা নয়। তবে লিবারেল ব্যবস্থার মধ্যে প্রতারণাকে সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। অন্যকে ঠকিয়ে সম্পদ অর্জন করাকে লিবারেলিজমের সাধারণ পরিণতি বিবেচনা করে লিবারেলিজম নামক তত্ত্বের বিরোধিতা দিনশেষে প্রতারকদেরই সুবিধা দেয়।

(অর্থনীতি কম বুঝি। তার ইতিহাস বুঝি আরো কম।) জমিদারি যতদিন আইনত বৈধ ছিল ততদিন তার ক্ষতিকে স্পষ্টভাবে মোকাবেলা করাও সহজ ছিল। কিন্তু জমিদারির ক্ষতি আর জমিদারি বিরোধিতা দুইটা এক হয়ে যাওয়ার মধ্যেই যে দারিদ্র্য মহান টাইপের ঘোর বা চেতনার ঘরে কেলেংকারি তৈরি হলো তা থেকে বাঙালকে মুক্ত করা না গেলে দারিদ্র্য দূর করা সহজ নয়। এই সমস্যা শেষমেশ চৈতন্যের। অর্থ যে ভাল, সে কথা আমাদের বুঝা দরকার। তাহলে জাতীয় অর্থ-সম্পদের হিসাবটা আরো স্বচ্ছ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

(পুনশ্চঃ - নজরুলের দারিদ্র্য কবিতাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। সম্পূর্ণ কবিতাকে না পড়ে তার অংশ থেকে দারিদ্র্যকে মহান করা নজরুলের সাথে টিটকারি। বোকামি করে ছাড় না দিলে এমন ব্যাখ্যাকে সাহিত্যের শয়তানি ব্যাখ্যা বলা যায়। দারিদ্র্য কাউকে মহৎ করে না। মহৎ লোকেরা মাঝে মাঝে দরিদ্র হয়ে জন্মায়। মূলত যে জীবন জীবনের প্রাচুর্যকে বুঝতে পারে তাকে আর্থিক বা অন্যকোন প্রাচুর্য দিয়ে আর মাপা যায় না, আটকানো যায় না। দারিদ্র্য অভিশাপ; দারিদ্র্য দূর না করার চেষ্টা আরো বড় অভিশাপ।)

Monday, September 20, 2021

ডিজিটাল বাংলাদেশ - লিটারেসি

 ২০১৯ সালে বাংলাদেশের পরিবেশ আইনের শিক্ষকদের সাথে কাঠমাণ্ডুতে একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ট্রেইন দ্যা ট্রেইনার্স প্রোগ্রাম ছিল তা। শিক্ষকদের শিখানোর কর্মশালা। পরিবেশ আইন বিষয়ে বাংলাদেশের দুইজন বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন সে কর্মশালায়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক -এর অর্থায়নে এবং তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এ কর্মশালায় টিচার্স ট্রেনিংয়ের দুজন বিশেষজ্ঞ এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে।

যাহোক, কর্মশালায় যে বিষয়গুলো শেখানো হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্লেন্ডেড লার্নিং বা হাইব্রিড ক্লাসরুম। এতদিনের প্রচলিত মেথডের সাথে বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে এসব পদ্ধতির মূল কথা। পাঁচ দিনের সেই ওয়ার্কশপে একটা প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশের মত ডিজিটাল বিভাজনের দেশে এমন শিক্ষার সুফল অল্প কিছু লোক পাবে। এই প্রশ্ন আমাকে বিচলিত করেছিল যে, বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে এজুকেশন ম্যানেজমেন্ট সহ আরো অসংখ্য দরকারি সফটওয়্যার তৈরির সক্ষমতা নেই, সেখানে এমন ধরনের ব্লেন্ডেড শিক্ষায় আমাদের অন্যদেশ থেকে এই ডিজিটাল সেবাগুলো কিনতে হবে। যেমন গুগল মিটে ক্লাস নিতে চাইলে তার সকল সুবিধা পাওয়ার জন্য গুগলকে ভাল পরিমাণ পয়সা দিতে হবে। একই সাথে জুম ব্যবহারের জন্য জুম কম্পানিকেও দিতে হবে। বাংলাদেশের ইউজিসি যা করেছে তা হলো জুমের কাছ থেকে সার্ভিস কিনে তা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে। ইউজিসির নিয়ন্ত্রাধীন যে বিডিরেন নামক স্থানীয় নেটওয়ার্ক রয়েছে তা একটি কাজের উদ্যোগ। একটি শক্তিশালী লোকাল/ন্যাশনাল সার্ভার থাকা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার একটি ডিজিটাল চিহ্ন। কিন্তু সফটওয়্যার ইত্যাদিতে বাংলাদেশের গ্লোবালি কম্পিটিটিব দক্ষতা নেই। বিশেষ করে এজুকেশন ম্যানেজমেন্টের জন্য। হয়তো দরকারও নেই। কারন পৃথিবীর বহু দেশেরই এই ধরনের সক্ষমতা অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ শুধু এই ধরনের সফটওয়্যার তৈরির ক্ষেত্রেই নয়। বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈষম্য। ইংরেজিতে ডিজিটাল ডিভাইড নামক পরিভাষার মাধ্যমে এই সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়। আমাদের প্রযুক্তির সুবিধা সবাই সমানভাবে পায় না। সমানভাবে পাওয়া হয়তো সম্ভবও নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এতো বেশি অসমান বা অসাম্যের যে তাতে একটা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত বর্তমান নানারকম বিপর্যয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ (এনজিও ভাষায় যাকে এক্সেস বা অভিগম্যতা হিসেবে অনুবাদ করা হয়) তা কম থাকা বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের বাড়তি আরেক ধাপ হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষমতা। আমরা যাকে সহজ ভাষায় বলতে পারি ডিজিটাল লিটারেসির অভাব।
ইউনেস্কোর প্রভাবে আমরা লিটারেসি মাপি। যদিও বিদ্যাবুদ্ধি মাপার সুযোগ বা যন্ত্রপাতি খুব একটা নেই। লিটারেসি মেপে আমরা খুবই আনন্দিত। ‘আনন্দ কি আনন্দ, এসে গেছে কোকা কোলা’ – আনন্দের চোটে আমরা গানের পরের লাইন আর গাই না – ‘ঋণের দায়ে সবই গেছে, বাকি আছে কাপড় খোলা’। প্রায় ষাট শতাংশ অক্ষরজ্ঞান তথা লিটারেসি মেপে আমরা জরুরি হিসাবের খোঁজ রাখি না। আমাদের ‘নিউমারেসি’ বা সংখ্যাজ্ঞানের যে ভয়ংকর দুর্বলতা রয়েছে তাতে করে সংখ্যাজ্ঞানের চেয়ে আমাদের সংখ্যাজ্যোতিষ বা নিউমারোলজিতে ঈমান এবং ভরসা পাক্কা। সংখ্যাজ্ঞানের বদলে সংখ্যাভীতি আমাদের চিরায়ত জাতীয় মহামারী। এসবের সাথে দুনিয়ার ডিজিটাল ওলটপালটের সাথে আমাদের ডিজিটাল লিটারেসির দুর্বল অবস্থা যোগ হয়েছে। মরার উপর খাড়ার ঘা।
ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানোর জন্য সিরিয়াস রাজনৈতিক উদ্যোগ লাগবে। ২০০৮ সালে নির্বাচিত রেজিমের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পরবর্তী রেজিমগুলোতে যে ডিজিটাল প্রতারণায় পরিণত হয়েছে তাতে সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশের এই চ্যালেঞ্জের সমাধান হবে না। ডিজিটাল লিটারেসির জন্য সামাজিক এবং রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার প্রচুর পরিমাণে। নয়তো বাংলাদেশের বহু ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। আক্রান্ত এই সমাজ আরও ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকবে।
মহামারীর শুরুতে যখন অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিল তখন আশা করেছিলাম পরীক্ষা পদ্ধতিতে হাতে লেখার বদলে টাইপ করার ব্যবস্থা চালু হবে। আমাদের একাডেমিক কমিটিতে এমন প্রস্তাবও দিয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত হাতে লিখে স্ক্যান করে খাতা জমা দেয়ার নিয়ম ঠিক করা হলো। এতে স্টুডেন্টদের কম্পিউটারে টাইপিং শেখার মোমেন্টামটা মিসে হয়ে গেল। টাইপ করে লেখার নিয়ম রাখলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ হতো যেগুলো সমাধান করার সক্ষমতা বা ইচ্ছা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিংবা শিক্ষার্থীদের ছিল না। যেমন অনেকের কম্পিউটার নেই; বেশিরভাগ স্মার্ট ফোনে ক্লাস করতে পারলেও টাইপ করার মত কমফোর্টেবল কোন ডিভাইস কেনার সক্ষমতা রাখে না। বিশেষ করে মহামারীর আর্থিক প্রভাবের কারনে। যদিও মোবাইলেও কিবোর্ড কানেক্ট করে লেখা যায়, তবে অনেকের জন্যই তা সুবিধাজনক নয়। এসব বাস্তব চ্যালেঞ্জের কারনেই আমরা ডিজিটাল লিটারেসির একটা গুরুত্বপূর্ণ মোমেন্টাম মিস করেছি। এই ডিভাইসের সমস্যা না থাকলে স্টুডেন্টরা টাইপ করে উত্তর লিখতে পারতো। তারা যে প্রশ্নগুলোর উত্তর হাতে লিখে দিচ্ছে তা তারা টাইপ করে জমা দিতো। এর ফলে তাদের টাইপিংটা শেখা হয়ে যেত এক সেমিস্টারেই।
#ডিজিটাল_বাংলাদেশ - লিটারেসি
#Digital_Bangladesh; #postpandemic_education

Saturday, September 11, 2021

 আমার রুমে আমরা উল্লেখযোগ্য দুজন থাকি।

পোকামাকড়রা থাকে হয়তো; লুকিয়ে পালিয়ে বিনা সমঝোতায়।
দুজনের একজন ছোট। কাপের ভিতর দাঁড়িয়ে থাকে সে। আমি চেয়ারে বসি, বিছানায় সটান হই, সোজা হয়ে হাঁটি: তার এসবের দরকার হয় না।
আমি দিনে আড়াই থেকে সাড়ে তিনবার খাই। কয়েকবার পানি গিলি, অন্তত এক ঢোক রোদ, এক আধবার খোলা বাতাস।
আমার ছোট কামড়ার অপর সদস্য যে, সরাসরি রোদে যাওয়া তার বারণ; মাঝে মাঝে জানালার খোলা বাতাস সে পায়; আর সপ্তাহে পাথর ভরা কাপে একটু পানি।
একটু একটু করে বেড়ে উঠছে সে। প্রাণের গতি, বেড়ে ওঠার তৃষ্ণা, সুন্দর হবার চেষ্টা - আমি দেখি। দেখে দেখে শিখি। এ শেখায় আনন্দ অফুরান।
বেড়ে ওঠার অপ্রতিরোধ্য এক স্বভাব এই প্রাণের।
ও একটি ছোট গাছ।
ওর নাম রাখা যেতে পারে ’ঞ’। নামটা একটু কঠিন তবে ছোট। এর চেয়ে বড় নামের ভার তাকে দিতে চাই না। যদিও ছোট নাম হিসেবে ’জ’ নামটা ওকে দিতে ইচ্ছে করে, তবে জ নামে আমার এক যন্ত্রবন্ধু আছে; তাই সে নাম তাকে দেয়া গেল না।
-
বন্ধু ঞ,
তোমার ছোট্ট শেকড় থেকে আমায় একটু স্থিরতা দিও।

Tuesday, September 7, 2021

চুল থেকে চম্পু

 হাঁটতে বের হলাম অনেকদিন পর। একটা নামকরা ওষুধের দোকান (সিভিএস) থেকে মাঝে মাঝে ডিম দুধ রুটি কিনি। আজকেও কিনলাম। পলিথিনের সাথে দোকানি মেয়ের চুলও চলে এসেছে। অফুরন্ত অবসর সময় থাকলে এই চুল কোন আগ্রহী যুবককে দিতে পারতাম। তাবিজ করার জন্য।

একবার নানুবাড়ি থেকে ফেরার পথে সমবয়সী এক কিশোরের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। সেভেন এইটের ঘটনা। উথাল পাতাল প্রেমে পড়লে মানুষের ভেতর যে ছটফটানি আর অস্থিরতা কাজ করে তার চলছি সেরকম দশা। সে আমাকে জানালো শহর থেকে আসা এক আত্মীয়ের প্রেমে পড়েছে সে। পরস্পর যে এর মধ্যেই লম্বা চিঠি আদান প্রদান করেছে তাও জানাল আমাকে। তারপর দেখালো সে সেই মেয়ের চুল নিয়ে এসেছে। দেশলাইয়ের বক্সে রুলটানা বাংলাখাতার ছেড়া পাতায় মোড়ানো। তাবিজ করবে সে তাকে। অই একটা বা দুইটা চুলের মধ্যে তার জীবন যেভাবে ঝুলে আছে তাতে আর জানতে চাইলাম না চুল কি ছিড়ে এনেছে নাকি ছেড়া চুল কুড়িয়ে এনেছে। কে জানে, চুলের জন্য চিরুনির দাঁতা বাঁকা করে রেখেছিল কিনা! আমার সাথে ছেলেটার দেখা হলো লঞ্চেই। মোটামুটি এক ঘন্টার পথ। এরমধ্যেই সে আমাকে বলতে থাকলো তার প্রেমের কথা। লঞ্চ থেকে নেমে নদীর পাড়ে বসে দীর্ঘসময় ধরে তার কথা শুনলাম। গল্প বলতে পারা লোক সহজে মিলে না জীবনে। প্রেমে পড়লে মানুষের গল্পের ক্ষমতা বেড়ে যায় হয়তো।
মানুষের আদিগল্পটা প্রেমেরই মনে হয় আমার কাছে। স্বর্গ থেকে দুনিয়ায় আসার পর প্রথম মানব আর প্রথম মানবীর কান্না কি সবটাই ক্ষমা প্রার্থনার? নাকি প্রেম ছিল পরস্পরের? বাবা আদম আর বিবি হাওয়ার কাছে জানতে চাই – আপনারা কি প্রেমের জন্য কাঁদেন নাই? যদি প্রেম না থাকলো তবে কিসের আরাফা? এখনো যারা সেখানে জমায়েত হন তারা কি মনে রাখেন, সেখানে প্রথম পুরুষ এবং প্রথম নারীর দেখা হয়েছিল! স্বর্গ থেকে বিচ্ছেদের পর সেই তাদের প্রথম দেখা! ‘মিলন হবে কতদিনে? আমার মনের মানুষের সনে।’ – এইতো ইয়াওমে আরাফার গান।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুরপথে ফিরছিলাম আম। পথে একটা মদের দোকানের সামনে দেখলাম চারজন যুবক। কাছে গিয়ে বুঝলাম তারা একটা মেশিনের সাথে লেনদেনের চেষ্টা করছে। এক ডলারের নোট দিয়ে মেশিনের কাছে কোক পেপসি চাইছে, আর মেশিন তাদের রিজেক্ট করছে। মেশিন জানাচ্ছে তুমি যেই সফট ড্রিংক খাইতে চাও, তা বিক্রি হয়ে গেছে। দোকানের ভিতরে গেলে সহজেই বিভিন্ন প্রজাতির অ্যালকোহল, সোডা, এমনকি ভাজাপোড়ার প্যাকেট পাওয়া যাবে। এশীয় যুবকরা অবশ্য মেশিনের কাছে ছাড়া কিনবে না। আমাকে তাদের কাছে দাঁড়াতে দেখে তারা খানিকটা বিব্রত কিংবা বিরক্ত হয়েছে হয়তো। আমি দোকানের ভিতরে গেলাম। ফিরে এসে দেখি তারা নেই। বসার যে বেঞ্চ ছিল তা আসমানের দিকে তাকায়ে হাহাকার করছে আর সফটড্রিংকের মেশিনটা হা হা করে হাসছে। কেমন চম্পু দিলাম, দেখলে?! কে যে কাকে চম্পু দিল, তাই বুঝতে পারিছ না।

Saturday, August 28, 2021

নফসে ওয়াহিদা

 একই নোনা সমুদ্র থেকে আমরা সাঁতরে উঠলাম বিভিন্ন মহাদেশে...

কেউ কেউ এখনো জলে...
সাঁতার কিংবা মাটি ছেড়ে,
কেউ কেউ ডানা ঝাপটায় দুরন্ত উড়ালে...
-
/অগাস্ট ২৭, ২০২১

Saturday, August 21, 2021

বেরাদার, তুমিও কি কাঁঠাল খাইছ?

 কাবুলিওয়ালাদের নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল বাংলায়। একটি কৌতুক ছিল কাঁঠাল খাওয়া নিয়ে। কাঁঠাল খেতে সুস্বাদু এ কথা শুনে এবং পাকা কাঁঠালের অসাধারণ ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে একজন কাবুলিওয়ালা কাঁঠাল কিনলেন। কাঁঠাল থেকে সুস্বাদু কোষ বের করে খাওয়া কোন সহজ কাজ নয়। বাঙালির খাদ্য জ্ঞানের ভিতর যেসব জটিল দক্ষতার ব্যাপার লুকিয়ে আছে তা কাঁঠাল খাওয়া তার একটি ভাল উদাহরণ। আমাদের এই গল্প কাবুলিওয়ালার কাঁঠাল খাওয়া বিষয়ে। বাঙ্গালির জটিল দক্ষতা যেহেতু তার নেই, তাই সে কাঁঠাল খেতে গিয়ে আঠায় জড়িয়ে গিয়েছে।

কাবুলিওয়ালাদেরে দাঁড়ি রবীন্দ্রনাথের মত। সেই রাবীন্দ্রিক দাঁড়ি কাঁঠালের আঠায় জট পাকিয়ে গেল। কাঁঠালের আঠা যে কতটা কঠিন, তা বাঙালির গানে পাওয়া উপমা থেকে বুঝা যায়। বাঙালির জটিল প্রেম এই আঠাকে তুলনার মান বিবেচনা করে: ‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়েনা/ গোলে মালে গোলে মালে পিরিত কইরো না।’ গোলে মালে পিরিত করে পিরিতির আঠায় যত মানুষ দুঃখ পেয়েছে – কাবুলিওলা দাঁড়িতে জট পাকিয়ে দুঃখ পেয়েছে তার চেয়ে বেশি।
গল্পের মাঝখানে বাঙালির কুবুদ্ধির উদাহরণ আছে। তাই ঝম্প দিয়া গল্পের শেষে যাই। গল্পটা অন্যের দুঃখ নিয়া হাসাহাসি করার। কারন দুঃখকে সবসময় আশকারা দিয়ে সুখের ভাগ কমানোর ইচ্ছা বেরসিক ব্যাপার। কাবুলিওয়ালা তার দাঁড়িকে কাঁঠালের আঠা থেকে মুক্ত করতে না পেরে নিজের তলোয়ার কিংবা নাপিতের খুর দিয়ে চোয়াল চেছে ফেলে। আয়নায় নিজের চেহারা মোবারক দেখে, তালেবান দেখা কাবুলের মত সে আৎকে উঠে। তার আর দুঃখ শেষ হয় না। বাংলার পথে ঘাটে সে তার মত অসংখ্য দুঃখী মানুষ আবিষ্কার করে ফেলে একদিনে। যাদেরকেই সে দেখে যে দাঁড়ি গোফ কামানো, তাদেরকে ধরে সে জিজ্ঞেস করে – ভায়া, তুম ভি কাঁঠাল খায়া? (বেরাদার, তুমিও কি কাঁঠাল খাইছ?)
এতদিন তো চামচ দিয়ে মাঝে মাঝে খাবার খেতাম। আজ থেকে কয়েকদিন চামচ নির্ভর হয়ে যেতে হবে। আজকের পর থেকে চামচ দিয়ে কাউকে খাবার খেতে দেখলে কাবুলি ব্রাদারের মতন আমিও হয়তো লোকদের জিজ্ঞেস করবো, ‘ভাই, তুমিও কি বোলিং খেলতে গেছিলা?’

*নখ কি তোমারও ভাঙছে যে কারনে হাত ধোয়ার ভয়ে চামচ দিয়ে খাও?
**বড় কোন সমস্যা না। আপনারা হাসাহাসি করতে পারেন। আর আশা হারায়েন না; ছোটখাট দুঃখেও উপকারী মানুষরা থাকে।
-
/ অগাস্ট ২০, ২০২১

Friday, August 20, 2021

পশু

 হয়তো আমি হাঁটব বলে আজ রাতের মেঘেরা এলোমেলো বা ঘোলাটে হয়ে থাকতে লজ্জা পেলো। তারা নিজেদের ভাগ্যমত পরিপাটি হয়ে ভাসছে। দশ বারো দিনের চাঁদ আকাশ জমিয়ে তুলেছে। একা একা যে উৎসব হতে পারে, সে কথা সম্ভবত চাঁদের কপালে লিখে রেখেছে ভাগ্যের বুড়ি। পাতাভরা গাছ, পরিচ্ছন্ন আর সাজানো হাটার পথ, আর হঠাত দেখা হয়ে যাওয়া দুএকজন মানুষ। মানুষেরা চুপচাপ চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে দ্রুত। ঘরে ফেরার তাড়া আছে; হয়তো ক্লান্তি আছে, অথবা আনন্দ। তারা হয়তো ভাবে – আজকের দিনটা ত কাটলো! আগামীর চিন্তা কমিয়ে রেখে একেকটা দিন তীব্রভাবে বেঁচে থাকার তৃপ্তি হয়তো তাদের চোখেমুখে। (অথবা গতির জীবন তাদের নাকমুখচোখ তীব্র করে রাখে চিরদিন। এমন ধারালো জীবনে দুঃখেরা ঠিক দখল নিতে পারে না। মৃত্যু স্বাভাবিক জেনেই বেঁচে থাকতে হয় প্রচণ্ড; তাই থাকছে তারা! জীবনের সম্ভাবনার ছিটে ফোটাও ঠিক ছেড়ে দেয়ার নয় – এমনই জীবন কি তাদের?)

আমি হাঁটি। কোথাও না যাওয়ার জন্য হাঁটি। মাটিতে আমার পা কেমন ভরসা পায়, রাতের ঠাণ্ডা বাতাস দরদ মাখে আমার গায়ে, চাঁদের আলো চোখে কেমন আনন্দ ঢালে – সেসব বুঝার জন্য হাঁটি। মোবাইল ফোন যাতে বিরক্ত না করে তাই জেন মুডে তাকে থামিয়ে রাখি। বাতাসের ঢেউ কখনো কখনো মেঘনা নদীর মমতার মত মনে হয়। মনে হয় দাঁড়িয়ে আছি রাতের লঞ্চের ছাদে। বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী পার হয়ে বাতাস আর নদীর স্রোত কেটে জাহাজ ভেসে চলছে। যেন আমি কোন বসতির দিকে যাচ্ছি না; যাচ্ছি কেবলই নদীর দিকে, অথবা বাতাসের দিকে, অথবা মেঘেরা যেখানে উড়ে তার পাশাপাশি কোন ঢেউ ভাঙা শব্দের দিকে...
এমন মিতস্বরের আনন্দ আর হাটাহাটির একদিনে আমার সাথে দেখা হলো একটি আহলাদি কুকুরের। নাম তার উইনি দ্যা পুডল। তাকে দেখতে লাগে ডল বা পুতুলের মতন। এমন অনেক পুতুল-কুকুর এ লোকালয়ে বাস করে। তবুও সেই তাদের মধ্যে প্রথম যে আমাকে দেখে থামল এবং আমার সাথে খাতির করতে চাইল। লেজ নাড়তে নাড়তে সে তার আহলাদ জানালো আমাকে। আমি তাকে কোলে নিলাম। জানলাম প্রায় সন্ধ্যায় পুডল হাটতে বের হয়।
পুডল যদিও পশুর মত নয়, তবু আমার পশুর কথা মনে পড়ল। পশু একটি বিড়ালের নাম। এই পৃথিবীতে সে প্রায় দশ বছর বেঁচেছিল। আমার সাথে তার খাতির ছিল না শুরুতে। এক সন্ধ্যায় সে আমাকে বিশ্বাস করলো। আমার কোলে উঠে ঘুমিয়ে থাকলো। আমার সাথে তার আর দেখা হবে না। হয়তো পুডলের সাথেও আর দেখা হবে না।
এমন অন্য কোন চাঁদের আলোয় আমি একটি নতুন গাছের পাশ দিয়ে যাব। শুভেচ্ছা জানিয়ে যাব আমার সাথে দেখা গাছদের। একই হাওয়ায় আমাদের আনন্দ হবে বেঁচে থাকার। যেসব গাছের কাছে ছোটখাট বিড়ম্বনা লুকিয়ে এলাম, তাদের সাথে দেখা হবে আবার। কোন সন্ধ্যায় কিংবা উজ্জ্বল রোদের দিনে। বহু গাছের কাছে জমা রেখে এসেছি নির্ভেজাল আনন্দের স্মৃতি। তারা কেউ কেউ হয়তো এখনো বেঁচে আছে; কেউ কেউ প্রিয় বিড়ালের হারিয়ে যাওয়ার দেশে ...

/ অগাস্ট ১৯, ২০২১

Monday, August 16, 2021

আফগানিস্তান ও বাঙালি মোসলমান

 সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক মত – যেকোন দেশেই বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে। বিদেশি হস্তক্ষেপ আর শাসনের বিরোধিতা আর ভেতরের কোন রাজনৈতিক শক্তিকে সমর্থন করা এক কথা নয়। তবুও কেউ কেউ এক করে ফেলার ঝোঁক এড়াতে পারেন না। বাংলাদেশে যারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কারনে আফগানিস্তানে মার্কিন ক্ষমতার পরাজয়ে আনন্দিত তারা এ ঝোঁক এড়ানোর জন্য অপেক্ষা করবেন হয়তো। সোজা কথায় তারা নিশ্চয়ই বুঝেন যে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জন্য তালেবান সমর্থক হওয়ার দরকার নাই।

বাংলাদেশের তালেবান-উৎসাহীদের অনেকে এ কারনে আনন্দিত না যে – তালেবান ন্যায়বিচারক, মানুষের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকার করে, আফগান মুসলমানদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর করে তুলতে চায়, কিংবা আফগান নারীদের অধিকার বাস্তবায়নে তারা উদ্যোগী নাহোক অন্তত সহনশীল; এমন কারনে তালেবান-উৎসাহী হওয়াটা মন্দ হতো না। কিন্তু অনেকের খুশির কারন হচ্ছে তালেবানের মোসলমানিত্ব এবং মোসলমানিত্বের নামে গোঁড়ামি। তালেবানের কট্টর মোসলমানিত্ব তালেবানকে প্রিয় করে তুলছে অনেকের কাছে। এরা মনে করে তালেবান আফগানিস্তানের অন্যান্যদের চাইতে এবং ক্ষেত্রবিশেষ তাদের নিজেদের চাইতে বেশি মুসলমান।
(মূলত উপমহাদেশের মাদরাসা শিক্ষায় এই একটা অহংকার শেখানো হয় যে পোশাক আশাক এবং ধর্মীয় শিক্ষার কারনে এরা অন্যদের চেয়ে বেশি মুসলমান। এমন অহংকারের এক্সট্রিম রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটেছে যেই তাকফীর ধারনার মধ্যে তাকে তালেবান তাদের যুদ্ধনীতিতে ব্যবহার করেছিল। তালেবান বা আলকায়েদার সেই আত্মঘাতী তাকফীর নীতির অর্থ হচ্ছে যে কোন মোসলমান ইসলামের আচার-আচরণ থেকে সরে গেলে অন্য মোসলমানকেও কাফের ঘোষণা করতে পারবে। এবং সেই যুদ্ধ প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফরজ। এই রকম পলিসির মাধ্যমে তারা ইসলাম বা শরীয়ার একটি সামগ্রিক এবং রাষ্ট্রীয় নীতিকে ব্যক্তিগত নীতিতে রূপান্তর করেছিল। শরীয়ার যুদ্ধ আইনকে ব্যবহার করেছিল তারা, যেমনটা হিউম্যানিটারিয়ান ল-কে ব্যবহার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।)
যদিও শিক্ষার কারিকুলাম এবং দর্শনের ক্ষেত্রে দেওবন্দের ধারা তাদের শেকড়, তবুও আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের যেসব মাদরসার তালেবরা তালেবান হিসেবে বিশেষ পরিচিত - সেসব মাদরাসায় সামরিক ট্রেনিং দিয়েছে আমেরিকা। তালেবান সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে আমেরিকার সহায়তায়।
ধর্মীয় শিক্ষার কারিকুলামে দেওবন্দী ধারার প্রতিষ্ঠানের সাথে তালেবানি শিক্ষার মিল থাকলেও সশস্ত্র হওয়ার দিক থেকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের কওমী শিক্ষার কন্টেন্ট বাংলাদেশ-ভারতের ক্বওমী শিক্ষার কন্টেন্ট থেকে আলাদা। এমনকি রাজনৈতিক দিক থেকেও তারা আলাদা। যদিও শিক্ষার কন্টেন্টে মিলের কারনে বাংলাদেশ থেকে আশির দশকে আফগানিস্তানে অনেকে গিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মাদরাসা আর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাদরাসা একরকম না। জঙ্গিবাদ বিরোধী বয়ানে এই পার্থক্য অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে।
তালেবানকে পপুলার অথরিটারিয়ান রেজিম হিসেবে ধরে নিয়ে বলা যায় অথরিটারিয়ান রেজিমে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অধিকার তথা সম্পদ বণ্টনের অধিকারের একটা সুযোগ থাকে। তালেবান আফগান নাগরিকদের জন্য সেই সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে চায় কিনা? নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বেলায় তালেবান গণতন্ত্র নয়, বরং আমিরাত বানাতে চায়। আমিরাত কোন সমাজতন্ত্র না; বরং এমন শাসন যাতে গোত্রতন্ত্র এবং পরিবারতন্ত্রের সুফল-কুফলের সাথে আফগান জনগণের ভাগ্য দুলতে থাকবে। আরো বহু দেশে যেমন ঝুলে। তবে তালেবান যদি গণতান্ত্রিক হতে চায়, নারীসহ আফগান জনগণের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকার করে এবং বাস্তবায়ন করে – তাহলে তালেবানকে অনেক বদলে যেতে হবে। যে বদল প্রকারান্তরে আমেরিকার আদর্শিক বিজয়।
সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম উপন্যাসে এবং দেশে বিদেশে নামক ভ্রমণ কাহিনীতে আফগানিস্তানের অল্প একটু ছবি দেখেছি। সভ্যতার ইতিহাসে সিল্করুটের ঝলমলানি বহু পুরাতন এই দেশ থেকে আলাদা করা যায় না। দেশে বিদেশের সেই বিশালদেহী বিরাটদিল এবং সহজ-সরল আব্দুর রহমানদের জীবন তালেবানি আফগানিস্তানে কেমন হবে, কাবুলসহ আরো সব উপত্যকার শবনমেরা কেবল হারিয়ে যাবে কিনা, সাধারণ আফগান জনতার জীবনের ছবি আপিম ক্ষেতের রোদে পুড়ে কেবলই রিলিফ ম্যাপের মতো হয়ে যাবে নাকি আঙুর লতার ছায়ায় মসৃন আর সতেজ হয়ে উঠবে - আমরা জানিনা। আফগানরা এতদিন কেমন ছিল তা নিয়ে তর্ক বৃথা। তবে মনে রাখা দরকার আপাতত সাধারন আফগান জনগণের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি এনে দেয়ার কোন জাদুমন্ত্র তালেবানের হাতে নেই। অলৌকিকতার আকাংখ্যায় আচ্ছন্ন বাঙালি মোসলমানরা এটুকু বুঝলে হয়!
-
অগাস্ট ১৫, ২০২১

Sunday, August 15, 2021

রেডবার্ড ডায়েরি - অগাস্ট ১৪, ২০২১

 অনেকেই জানেন যে আমেরিকায় পড়ালেখার সেমিস্টার মোট তিনটা। ফল, স্প্রিং, আর সামার। সামারে সাধারণত ছুটি থাকে। প্রায় তিনমাস। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি। গরমকাল। লোকেরা ঘর থেকে বের হয়, ঘুরতে যায়। আমোদ করে।আর ফলে পড়ালেখার বছর শুরু হয়। মানে বেশিরভাগ ভর্তি হয় ফল সেমিস্টারে। আগস্টের মাঝামাঝি।

আমি এসছিলাম স্প্রিংয়ে। জানুয়ারির শুরুতে। নামে বসন্ত হলেও জমানো শীত ছিল তখন। অবশ্য সেমিস্টারের শেষ দিকে রঙিন সব ফুলের জমজমাট প্রদশর্নী হয়েছিল গাছে গাছে। ‘কি ভাল আমার লাগল’ সে কথা চিল্কায় গিয়ে বুদ্ধদেবও টের পান নাই।
বিদেশ আইসা বহুমানুষ যেমন বিভিন্ন অদৃশ্য ধাক্কা খায়, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে আমিও খেয়েছি বেশ। বাঙালির পোড়ামন, গৃহপালিত আবেগসমূহ, আর বাঙাল রাষ্ট্রের মানুষবিরোধী নীতি এবং শাসন - আমার পুরাতন দুঃখ। এগুলো আমাকে ছাড়ে নাই। যদিও আমি ভাবি এসবের অনেক কিছুই আমি কাটায়ে উঠতে পেরেছি, কিন্তু তারা মাঝে মাঝে জানান দিতে থাকে আমি পারি নাই। এসবের সাথে নতুন বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার যোগ হলো।
আমেরিকার ঘরবাড়ির সাথে অভ্যস্ত হতেই আমার সময় লাগলো। বহুদিন পর আবার স্টুডেন্ট হয়ে যাওয়াটা কিঞ্চিৎ চ্যালেঞ্জিং ছিল। পড়ানোর জন্য কতকিছু পড়া হয়ে যেত। আমার স্টুডেন্টদের কারনেই আমি অনেক কিছু পড়েছি, এছাড়া আমি সেল্প মোটিভেটেড হয়ে কাজ করতে পারি কম - এসব কাহিনী আবিষ্কার হলো।
গত সেমিস্টারে এসব উপলব্দির পাশাপাশি নতুন কিছু শিখলাম। এর মধ্যে সবচে ভাল লাগলো Zotero নামক একটা সফটওয়্যারের ব্যবহার শিখে। আর সমাজবিজ্ঞান আবিষ্কার হলো নতুন করে। বইপত্র বা রিসোর্চ পাওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা এখানে পেলাম, শুধু তার জন্যই অনেক কষ্ট হজম করা যায়। (বাংলাদেশেও আগামী এক দশকে অনেক রিসোর্চ পাওয়া যাবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক সবলতা অর্জন করতে সময় লাগতে পারে আরো বেশি।)
সামারে কোর্স না নিলেও চলতো। যাতে মাস্টার্স একটু আগে শেষ করতে পারি তাই আমি একটা নিয়েছিলাম। কোর্সটা পছন্দ করে ফেলছি খুব। কোর্সের নাম আইন ও সমাজ ওরফে আইনের সমাজতত্ত্ব।
গরমকালের অলস দিন কালকেই শেষ। পরশুদিন থেকে দৌড়ের উপর থাকব মনে হচ্ছে। ফল সেমিস্টারের ক্লাস এবং কাজ শুরু। সেমিস্টারের শুরুতে ‘ভাল হয়ে যাব এবার’ টাইপের যে মোটিভেশন কাজ করে, তা সবাইরে জানান দিয়ে রাখলাম। এই সেমিস্টারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব আর কর্পোরেট ক্রাইম পড়বো। খুবই এক্সাইটেড হয়ে যাচ্ছি কন্টেন্ট দেখে।

Thursday, August 5, 2021

মোরাল গুণ্ডামি ও হজরত ঈসা (আ.)

নাজারাতের মহাপুরুষ হযরত ঈসা রুহুল্লাহ যখন জেরুজালেমে গেলেন তখনকার ঘটনা। তখনকার নীতি-গুন্ডারা এক মহিলাকে মারার জন্য তাড়াচ্ছিল। মহিলার অপরাধ সে প্রস্টিটিউট। তার এই অনৈতিক কাজের জন্য তাকে পাথর ছুড়ে হত্যা করতে চায় সবাই। হযরত ঈসা রুহুল্লাহ গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন। মহিলা দৌড়ে এসে সেখানে এক দেয়ালের কাছে আটকে গেল। যাওয়ার আর জায়গা নেই। উত্তেজিত নীতি-গুণ্ডারাও সেখানে এসে থামল। হযরত ঈসা রুহুল্লাহ কথা বলতে পারতেন চমৎকার। (যখনই তিনি গল্প বলতেন কেউ না শুনে পারত না। জুদাস ত ভাবছিলেন রোমান বিচারক আর ইহুদী রাব্বি সবাইকে তিনি কনভিন্সড করে ফেলতে পারবেন তার ঐশ্বরিক কথা এবং কথা বলার শক্তিতে।)

তিনি বুঝেছিলেন ঐ উত্তেজিত মব তথা মোরাল-গুণ্ডাদের বুঝানোর সুযোগ খুব কম। মোরালিটিতে উত্তেজিত হয়ে পড়লে লোকজন আর ওয়াজ নসিহতও ব্যাখ্যা শুনতে চায় না। হযরত ঈসা রুহুল্লাহ তাদের জানালেন, আচ্ছা তোমরা পাথর মারতে চাও মারবা। তাতে কোন সমস্যা নাই। যেহেতু এই মহিলা পাপ করেছে তাই তাকে শাস্তি পেতে হবে। মহিলা চমকে গেলেন। আশ্রয়ের জন্য যার কাছে গেলেন তিনি যদি এমন কথা বলেন তার চেয়ে দুর্দশার আর কি আছে!

নাজারাতের মহাপুরুষ হযরত ঈসা (আ.) তাদের জানালেন, তোমরা পাথর মারতে পারো। তবে তোমাদের মধ্যে যে কোনদিন পাপ করে নাই, সেই প্রথম পাথরটা মারো। উত্তেজিত জনতা কনফিউজড হয়ে হজরতের দিকে এবং একে অন্যের দিকে তাকালো। মেঘমন্দ্র স্বরে হজরত ঈসা (আ.) আবার বললেন, তোমাদের মধ্যে যে কোনদিন পাপ করে নাই, সেই প্রথম পাথরটা মারো। আরো একবার বলার পরও এমন কাউকে আবিষ্কার করা গেল না। দয়াল নবী হজরত ঈসা রুহুল্লাহর প্রতি বিরক্ত হয়ে জেরুজালেমের মোরাল-গুণ্ডারা ঐ জায়গা থেকে কেটে পড়লো।

আইন-শৃংখ্যলা বাহিনীর প্রতি আস্থার ঘাটতি ও পরীমনির ফেসবুক লাইভ

পরীমনিকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি লাইভে এসেছেন। আগেও হয়রানির শিকার হওয়ার পর এসেছিলেন। তবে দুই ঘটনাতেই পরীমনির লাইভে আসার সিদ্ধান্ত একটি বার্তা দিচ্ছে। আইন-শৃংখ্যলা ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আস্থাহীনতা শুধু বর্তমান রেজিমের বিরোধী মত ও সমালোচকদেরই নয়, বরং এই রেজিমের সমর্থক এবং বেনিফিশিয়ারিদের মধ্যেও রয়েছে।

পরীমনি যে জানিয়েছেন, যারা তার বাসায় এসেছিল তারা যথাযথভাবে তাদের পরিচয় দেননি। তাদের ইউনিফর্ম ছিল না। তিনি ভয় পেয়েছেন এবং নিশ্চিত হতে পারেননি যে যারা গিয়েছে তারা আইন-শৃংখ্যলা বাহিনীর লোক।

লাইভের শেষ দিকে এসে জানা গেল তার বাসার নিচে র‌্যাবের ও পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দরজার সামনে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা ইউনিফর্ম পরিহিত।

এই আস্থাহীনতা দূর করার জন্য আইন-শৃংখ্যলা বাহিনীর ভিতর থেকেই সমাধানের রাস্তা খুঁজতে হবে।



বাঙাল বিপুল উৎসাহে মোরাল গেইম খেলেছে। পরীমনির দুরাবস্থাকে পোয়েটিক জাস্টিস হিসেবে বিবেচনা করে ফেসবুকে হা হা করেছে। তাদের অনেকে নির্মলেন্দু গুণের সাথে একমত হওয়া সত্ত্বেও মোরাল কনফিউশনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।

এছাড়া সেলিব্রেটি না হলে লাইভে আসার প্রভাব কেমন হতো তা অন্য ঘটনা থেকে জানা যাবে।

Monday, July 26, 2021

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ

অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ভাল উপস্থিত বক্তৃতা দিতে পারেন, গল্প বলেন চমৎকার, আর মোটিভেশন দিতেও দক্ষ। অথচ এসব কারনে কখনো তার প্রতি মুগ্ধ হইনি। কারন যে বয়সে এসব আমাকে অবিভূত করতো সে বয়স পার করেই তাকে আমি চিনেছি। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের পুরাতন বিল্ডিংয়ের ছাদে একবার আড্ডায় উপস্থিত ছিলাম। তিনি কি বলেছেন তা আমার মনে নেই, তবে মুড়ি পিয়াজু চা খাওয়ার স্মৃতি মনে আছে।
জন্মদিন উপলক্ষ্যে লোকজন তার দোষত্রুটি প্রচার করছেন। এসবের মধ্যে দোষগুলা কি বুঝা মুশকিল। নির্বিচার গালাগাল করতে যাদের আগ্রহ তাদের একটা অংশ হচ্ছে ঘৃণাজীবী অ্যান্টিসেক্যুলার। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ যেহেতু সেক্যুলার কাজেই তাকে নিন্দা করতে হবে। এবং তা করতে হবে কিছুটা ক্রিটিকাল বুদ্ধিজীবী সেজে। আসল মতলবটা লুকিয়ে রাখতে হবে। অবশ্য চেতনাজীবীরাও তাকে ছাড় দিতে নারাজ। মাঝে মাঝে বেফাস কথা বলে তাদের চেতনা ব্যবসার কিছু ক্ষেতি তিনি করেছেন।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মত অসংখ্য উদ্যমী সংগঠক এবং শিক্ষক আমাদের দরকার ছিল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মতন সংগঠন তার সবচে বড় সাফল্য। বাঙালির সংগঠন করার যে দুর্বলতা তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। (তার বই 'সংগঠন ও বাঙালি'তে তা লিখেছেন।) ভিতরের বাইরের বহু প্রতিরোধ কাটিয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মত সংগঠন তিনি তৈরি করেছেন। গত এক দশকে বাংলা ভাষায় যে পরিমাণ বই স্বল্পদামে এবং সুন্দর ছাপায় কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছে সমালোচকরা সেসবের খবর রাখেন কিনা জানিনা। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে নাকচ করে দেয়া সহজ নয়, গড়পড়তা বাঙালী বুদ্ধিজীবীর চাইতে বাড়তি উদ্যমটুকু তিনি কাজে লাগিয়েছেন। আমাদের ছোট গায়ের ছোট ছোট ঘরে থাকতে থাকতে আমাদের বিচার কেবলই আত্মঘাতী হয়ে উঠে।
অবশ্য চিরদিনের জন্য তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে থাকা কারো কারো জ্ঞান স্বাস্থ্যের জন্য বাধা হয়ে থাকতে পারে। যে কারো কথাকে নির্বিচারে গ্রহণ করা বা মান্য করাও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। তবে এমন বাধা ভক্তের, গুরুর উপর সেই দায় চাপানোটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখা উচিত।
যাহোক, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের সমালোচকদের লেখা দেখে ভানু বন্দোপাধ্যায়ের ‘চোখে আঙ্গুল দাদা’-র কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের ‘চোখে আঙুল দাদা’রা কি গড়েছেন জীবনে?
-
জুলাই ২৫, ২০২১

Sunday, July 25, 2021

জীবন যন্ত্রণা

 জীবনের যন্ত্রনা বিষয়ে কিছুদিন আগে একখানা কৌতুক ধার করেছি। পাওনাদার সৈয়দ মুজতবা আলী। তার সাথে এক উকিলের পরকাল বেহেশত দোজখ ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ হয়েছিল। কথায় কথায় উকিল জানাল যে - ’আমি বেহেশতে বিশ্বাস করি, দোজখে আমার বিশ্বাস নাই। মৃত্যুর পর সকলেই স্বর্গে যাবে।’

উকিলের ব্যাখ্যা হচ্ছে বেহেশতে কালাভুনার ডেগচি ঘুরে বেড়াবে, আস্ত রোস্ট গাছে ঝুলবে, শরাব মধু দুধ নদী হয়ে বইবে। আরাম আয়েশ ভোগবিলাসের কোন কমতি থাকবে না। চাহিবা মাত্র সকলই পাওয়া যাবে।এসব তো কল্পনা করা যায়, তাই বেহেশত আছে।
আর নরকের ব্যাপারটা কল্পনাতেও আসে না। এই দুনিয়ার চাইতেও খারাপ জায়গা হয় নাকি! কাজেই দোজখ নাই।
এই কৌতুক কিংবা বজ্রপাতের হাসাহাসিতে আপনারা জানেন, দুনিয়ার চাইতে যন্ত্রনাময় জায়গা আর নাই। জীবন যে শিটি ব্যাপার তা আপনারা জীবন দেখে অনেকেই বুঝে গেছেন। মোটিভেশন লেখকরা দিবালোকের ন্যায় ফকফকা করে লিখে রেখেছেন, এই শিটি জীবনে বুলশিট কাউশিট কোনটা গায়ে মাখবেন তা জাইন্যা আর মাইন্যা নিলেই কেল্লা ফতে। মানে জীবন যুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত।
আপনারা এই কথা অন্তরে ঢুকায়ে নিতে পারেন, জীবনের যন্ত্রণা হইতে মানুষের নিস্তার নাই, আর মোহমুক্তির সাধনা করার জন্য ডুমুরতলাও (মানে ত্বীন ফলের গাছও) সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না, কাজেই যন্ত্রণা বাছাই করার স্বাধীনতাই মানুষের আদি ও আসল স্বাধীনতা।
-
(বাংলা ভাষায় ’স্বাধীনতা ব্যবসায়’ কিতাবেও গ্রিক পুরাণ থেকে ধার করে এমন কথা বাজারে ছাড়া হয়েছে। স্বাধীনতা ব্যবসায় মূলত স্বাধীনতা বিরোধী কিতাব। লিবারেলিজমের ক্রিটিক এবং ক্রিটিকের তর্জমা। পেইন বাইছা লওয়ার নামই স্বাধীনতা ব্যবসা। বন্ধুদের বলে রাখি, উক্ত কিতাবের অসমআলোচনা লেখার ইচ্ছা এখনও যন্ত্রণা পর্যন্ত গড়ায় নাই।)

-
/ জুলাই ২৪, ২০২১

করোনার ভিন্ন প্রভাব

 করোনার কারনে কতকিছুই বদলে গিয়েছে। ঢাকায় ৮ মার্চ ২০২০ এ করোনা সনাক্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই জ্বর-কাশি-গলাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ আমাকে দেখা দিয়ে গেল।

তারপর ঘটনা ঘটতে থাকল বহু বিচিত্র উপায়ে। অনলাইনে এক সেমিস্টার পড়ালাম।
করোনায় অনেক পরিবর্তনের সাথে আমার জীবনে যে পরিবর্তন ঘটলো সে হচ্ছে শার্ট ইন করা ভুলে গিয়েছি। অনলাইনে মাস্টারি করে প্রায় দেড় বছর কাটিয়ে দিলেন যে শিক্ষকরা তাদের অনেকেই আমার মত প্যান্টের ভেতর শার্টের উদার পাশটা লুকানোর অভ্যাস হারায়ে ফেলছেন। বাঙালির লুঙ্গিতে যে আরাম, দীর্ঘ লক ডাউনের কালে অনেকেই তা ভবিষ্যতের পাওনাসহ পুষিয়ে নিয়েছেন।
স্টুডেন্টদের অনেকের শার্ট প্যান্ট পরার দরকার কমেছে। লুঙ্গি গেঞ্জিতে ভালই চালিয়ে নেয়া যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। পায়জামার উপর শার্ট পরে আমি যে দীর্ঘদিন ক্লাস নিলাম - এই কথা যাতে ভুলে না যাই, তাই লিখে রাখছি।
করোনার এই লুঙ্গিপ্যান্ট সংক্রান্ত প্রভাব বাজারেও পড়ার কথা। অনুমান করি গত দেড় বছরে ইয়াংদের ব্যবহারের জন্য লুঙ্গির বিক্রি বেড়েছে; প্যান্টের বিক্রি কমেছে।
ভিন্ন ধরনের জটিলতাও আছে। মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে তা টের পাওয়া যাবে। মানে অনেকের প্যান্ট আর কোমড়ে বনিবনা হচ্ছে না; কারো কারো জামার সাথে চলছে মনোমালিন্য। কোভিড পরবর্তীতে বেসাইজ বাতিল হওয়া জামাকাপড়ের সদগতির উদ্যোগ কাজে লাগতে পারে।
অনেকের জুতার ভেতর মাকড়সা বা ইঁদুর বাস করার সম্ভাবনা আছে। পায়ের সাথে জুতার পরিচয় ঘটতে অনেকদিন লেগে যাবে আবার। যাহোক, প্যান্টের কোমড় না হয় কিছুটা বাড়ানো যাবে, বেল্টও হয়তো চালিয়ে নেয়া যাবে, তবে আপনারা প্রার্থনা করেন মাস্টাররা প্যান্ট পরা ভুলে গেলেও অন্তত জিপার আটকানোর অভ্যাসটা যেন না ভুলে। ধুতি লুঙ্গি পায়জামা ঘুরে প্যান্টে এখনো থিতু হয় নাই বাঙালি।
-
/ জুলাই ২৪, ২০২১

Saturday, July 10, 2021

হাড্ডি

পুড়ে যাওয়া ভবনের অনুমতি ছিলনা;
শিশু শ্রমের ব্যতিক্রমি অনুমতি আইনে ছিল,
শিশু জন্মানোর অনুমতি ছিল না অগো বাপ-মায়ের;
আগুনভরা কারখানায় জানালা বন্ধ আর সিঁড়ি না রাখার অনুমতি ছিল,
তবে আজরাঈলের অনুমতি ছিলনা জান কবজ করার;

যদিও আল্লাহর রহমতে বাইচা গেল শ খানেক মানুষ।
শয়তানের ওয়াসওয়াসায় মরল ৫১।
দেড়হাজারের বেশি লোকে বেহেশতের এই ছয়তলায় করত কাজ;
আলহামদুলিল্লাহ ফর এভরিথিং, ওভারটাইমে মাত্র দেড়-দুইশ ছিল আজ।

জুসের স্ট্র বসাইয়া খাইতেছিলাম তাগো রক্ত
শালার গরীবগুলা জন্মায় শুকনা হাড্ডি হাড্ডি শরীরে
রক্ত বের হয় খেঁজুর গাছ চাঁছার তৃতীয় দিনের মতো

তবে সুবিধা একটা আছে
গাদাগাদি কইরা হাসেমের ছয় খোপ উন্নয়ন স্বর্গে
হাজার দেড়েক রাখলেও তারা কর্ম করিয়া বাঁচে

চিকন দরজা আর সিঁড়ি দিয়াও অনায়াসে
দল বাইন্ধা তারা ঢুইকা পড়ে সুড়সুড়
যেন অল্প পানিতে পাতা চাইয়ে
ঝাকে ঝাকে পুটির পোনা খাইত মরনগুড়
মচমচা ভাজা পুটি, আহা, ৪৮টা পেলে
প্লেটে পেটে নাস্তা হতো
বর্ষার বৈকালে।

দিনটা বাঙালি হতো, খাঁটিও অল্পনা;
গতরে পুটির কম – এইসব গরীবের ছাও,
হুদাই উড়ায়ে দিল ফ্রাইড ফিশ কল্পনা।

আমি অভিজ্ঞ মানুষ। মানুষ গরু চিনি।
বলদার পো* দিয়া টাকা বেরয় না
মোবাইল কম্পানিতে কথা বেচা মধ্যবিত্তের সাথে
এমন সরল সত্যও জানি।

তবে আমি আরো জানি বাঁকা অংকটাও।
একেকটা পোড়া বলদের দাম মন্দ না
জ্যান্ত বলদ বছরে গোবর দেয় হাজার হাজার টেকার;
এইসব পোড়া গরীবের হাড্ডি দিয়া
দশটেকার দাঁত খিলানও বানানো যায় না।
সেই তাগো আবার ভণিতা আবদার:
‘আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুইজ্জা দেন স্যার’।

এই ছোট শুকনা হাড্ডি দিয়া করবি কি?
ডিসি সাহেব বলেছেন – বিইশ হাজা-া-র টাকা দেয়া হবে
লাশ প্রতি (মানে এক সেট হাড্ডির জন্য)
তোরা সেই টাকা দিয়া বলদের হাড্ডি কিনলে অনেক ওজনদার হাড্ডি পাবি,
সামনেই কোরবানী
এখনই খোঁজ রাখলে খোদার দয়ায় হাড্ডি কিনার সুযোগ মিলতে পারে নসিবে
যা, টাকা পাইলে ভারি ভারি হাড্ডি কিনিস।
অহন ঘ্যান ঘ্যান করিস না; দল বাইন্ধা ঘ্যান ঘ্যান করলে
তোদের হাড্ডি ভাইঙা যাবে মহামান্য আইনশৃংখ্যলার শিংয়ের গুতায়।

তা ছাড়া বিল্ডিংয়ে কি আমি আগুন দিছি?
গরীবের হাড্ডিতে ঠোকাঠুকি কইরাই এই আগুন লাগছে।

(আমি তাজ্জব হয়া যাই —
এই গরীবগুলার হাড্ডির ভিতর থেইকাও প্রেম বাইর হয়;
দাউ দাউ আগুনের ভিতর
প্রায় বন্ধ হইয়া যাওয়া শ্বাস লইয়াও
এক মাইয়া তার স্বামীরে ফোন কইরা জানাইছে – বিল্ডিংয়ে আগুন লাগছে।
লাইলি মজনু না
বেহুলা লখিন্দর না
রোমিও জুলিয়েট না
কাগজের আগুনে পুইড়া ছাই হয়া যায় এমন পলকা দেহ আর পাতলা হাড্ডির ভিতর কত ঢং
মৃত্যুর আগেও প্রিয় মানুষ খোঁজে!)

যাইহোক, সবকিছুকেই দেখতে হবে পজিটিবলি।
তাজরীন, নিমতলি, চকবাজার, বনানী, আর সব পোড়া বস্তি থেইকা উন্নয়ন পর্যন্ত আমাদের লেসন নিতে হবে।
কবি তাই বহু আগেই বলে গেছেন —
‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া’
হাসি উন্নয়নের হাসি।

Friday, July 9, 2021

পাগলা ডুমুর ১

দাদা ভান্তে একদা আরেক সাধু সহ সফর শুরু করেছিলেন। সাধু তপস্বী জীবন, চর্চার মধ্যেই প্রকাশ পায়। সফর চলতে থাকে। কামনা বাসনা থেকে মুক্তির পথে নারীসঙ্গ বড় বিপদজনক বাসনার উৎস। মুনিদের ধ্যান ভাঙার জন্য নারীদের নাম বদনাম দুইই শোনা যায়। ‍কিশোর বয়সে এক তুর্কি দরবেশের কথা বেশ তাজ্জব করেছিল; তুর্কি দরবেশ বলেছিলেন, একটা দেশলাইয়ের কাঠি যেমন রোম, টোকিও, কিংবা লন্ডন পুড়িয়ে ফেলতে পারে, একজন নারীর এক পলক চাহনি এক হাজার বছরের ইবাদত বন্দেগী তেমন ছাই করে দিতে পারে। রোম আবার গড়া যায়, কাগজের টোকিও সিমেন্টে পাথরে বিস্তর হয়ে উঠতে পারে, লন্ডনও রয়াল সোসাইটির প্লানে আরো ঝাকুম-ঝুকুম কসমোপলিটান হয় — তবে এক জীবনের ইবাদত বন্দেগী পুনরায় ঠিকঠাক করার চান্স শূন্যের কাছাকাছি। তাই প্রেম বা প্রেমাধিক আকাংখ্যার ভয় মুনিঋষিরা চিরদিন সাধনার পথে ঝুলিয়ে রেখেছেন।

এক্ষনে যে দাদা ভান্তে আর তার সাগরেদের কথা কহিলাম তিনিও ব্যতিক্রম নন। তাহাদের যাত্রা পথে একটি একহাটু জল কিন্তু হাটু কাঁপানো স্রোতের নদীর দেখা মিলিল। নদীর পাড়ে সাজসজ্জায় রূপ বাড়াইয়া এক রুপবতী নারী অপেক্ষমান। মুনিঋষিদের যাত্রা পথে বিপদ একলাই আসে। ভ্রার্তৃ-পুত্র-পিত কেহ সহায় হইয়া থাকে না। যদিও এখনকার সচেতন সাহিত্যে কিশোরী তরুণী সকলেই অন্তত প্রিয়ংবদা সহযোগে শকুন্তলার মত গল্প উপন্যাসে বিচরণ করেন। যাহোক, হাটু কাঁপানো স্রোতস্বিনী পার হইবার সাহস যদি রুপসীর থাকিত তবে প্রজ্ঞার ঈশ্বর তাকে দাদা ভান্তের কাধে চড়াইত না। রূপসীকে দাদা ভান্তে কাধে চড়াইয়া —বর্ষাকালের বাঙালি জামাইরা যেমন নতুন বউকে উদ্ধার করেন, সেইমতন— নদী পাড় করাইয়া দিলেন।

পুনরায় পথ চলিতে লাগিলেন তারা। শিষ্য কিছুতেই আহত বাকবুদ্ধিকে সুস্থ করিতে পারিল না। বারবার দাদা ভান্তেকে জিজ্ঞাসা করিল আপনি এই কাজ কেন করিলেন। সাধনার পথে এমন কর্ম হইতে দূরে থাকিবার নিয়ম। রূপবতী শুধু দেখিলে না হয় অল্প বলিয়া ছাড় দেয়া যাইত; আপনি ত শুধু দেখেন নাই, ছুঁইয়াছেন। শুধু স্পর্শ করিয়াছেন বলিলে আমার কাতরতা শেষ হয় না, আপনি তাহাকে কাধে লইয়াছেন। তাও যদি কাধে লইয়াই আপনার ভুল বুঝিতে পারিয়া সাথে সাথে নামাইয়া রাখিতেন, তাতেও আমার ‍গুরুভক্তি রক্ষা পাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। আপনি এক অপরিচিত রূপবতী নারীকে কাধে চড়াইয়া নদী পার করিয়া দিয়াছেন। সদাশয় গুরু ভান্তে, আপনার প্রতি আমার ভক্তির উষ্ণতার ভেতর স্রোতস্বিনীর শীতল জল না ঢালিয়া দিলে আজ আমার তপস্বার অগ্রগতি এমন করিয়া নদীতীরে আছাড় খাইত না।

দাদা ভান্তে চুপ থাকিয়া যাত্রাপথ অতিক্রম করিতেছিলেন। কয়েকমাইল হাঁটার পর দিনান্তের বিশ্রামের জন্য তিনি থামিলেন। শিষ্য দাদা ভান্তেকে এই রুপবতীকে স্কন্ধদান বিষয়ে প্রশ্নে কটাক্ষে ত্যক্তবিরক্ত করিবার চেষ্টা হইতে বিশ্রাম লাভের কোন লক্ষ্যণ দেখাইল না। অতঃপর দাদা ভান্তে মুখ খুলিলেন। বলিলেন, আমি তো তরুনীকে নদীর পাড়ে রাখিয়া আসিয়াছি, তুমি এখনো তাহাকে বহিয়া বেড়াও কেন?
-

দাদা ভান্তের সাথে আমরা শিষ্য মারফত আর কোন আলাপ যাতে করিতে না পারি প্রজ্ঞার ঈশ্বর সেই ব্যবস্থা করিয়াছেন গল্প শেষ করিয়া। তবুও আমরা আমাদের জীবনে বহু বোঝা বহিয়া বেড়াই, জীবন কুঁজো হয়ে যায় সটান দেহ আর শ্যাম্পুকরা চুলের নিচে মগজের ভেতর।

Thursday, July 1, 2021

আহমদ ছফার বাসনা

 আহমদ ছফার চিন্তার বৈপরিত্য খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু চিন্তার বৈপরিত্য বা কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কি যুক্তি দিয়েছেন তার চেয়ে বড় ছফার বাসনা। ছফার বাসনার কারনেই ছফা গুরুত্বপূর্ণ। ছফার বাসনা কি ছিল?

একটা স্বাধীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এমন একটা জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র পাওয়ার গল্প তিনি বলেছেন যে, জনগোষ্ঠী এই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ সবই বদলে দেবে। দিয়েছে। উপমহাদেশের ইতিহাসে এখনো বাংলাদেশের এই উত্থানের প্রভাব লেখা হয়নি। আর বাংলাদেশের সম্ভাবনা দেখার মতন স্থিরতা আমাদের কপালে জুটেনি।
ছফা জানাচ্ছেন জাতি রাষ্ট্র হিসেবে এই অঞ্চলে পাকিস্তান এবং ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে আধুনিক রাষ্ট্র। ভারত এবং পাকিস্তানের একজাতি বা দ্বিজাতি দুটিই যে মিথ্যা কথা - তা বুঝা যায় বাংলাদেশের রাষ্ট্র হওয়ার মধ্য দিয়ে। কারন এই অঞ্চল বহুজাতির। এক ভারতীয় বা দুই হিন্দু-মুসলিম জাতির মাত্র নয়।
সেক্যুলার বাঙালি মুসলমানের দরবেশ ছিলেন আহমদ ছফা। তার দরবেশ সুলভ জীবনের কারনে তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হইতে থাকে। অন্য অনেকেই হয়তো ছফার মতো জাগ্রত বাংলাদেশের বাসনা বুকে নিয়ে জীবন কাটাইছেন কিন্তু ছফা ঘর সংসার চাকরি বাকরি করেন নাই বলে তাকে আর কোন পরিচয়ে আড়াল করা যায় নাই।
-
/জুন ৩০, ২০২১

Wednesday, June 30, 2021

প্রলাপ

ইদানিং মুশকিল হচ্ছে। আগেও হতো মাঝে মাঝে।
বাঙালি চেহারা ফেসবুকের বাইরে খুব কম দেখি। তাতে মানুষগুলো কল্পনায় হাটাচলা শুরু করে। হয়তো পুরাতন ইটের রাস্তার ছবি দেখলাম, তাতে দূর্বাঘাসও দেখা হয়ে যায়। কল্পনার মানুষদের কথাবার্তা শোনার আগেই মাথা টনটন করে।
হলদে রঙের রাবার ব্যান্ড পরা কন্যার চুলের ঝুটি আমার কল্পনায় নড়তে শুরু করে। সংলাপহীন এই জ্যন্ত সব কল্পনারা মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।
অন্তত ফেসবুকে বাঙালীর গভীর বেদনাভরা মুখের উপস্থিতি কম। রাস্তায় রাস্তায় দেখা হওয়া করুন মুখেরা এখনো ডিজিটাল ডিভাইডের অপর পাশে বেশি মনে হয়।
আপন দুঃখ পরকে দেখাব না বলে আমাদের দুঃখের মুহুর্তরা এখানে এই ভার্চুয়াল গঙায় ভাসে না।
যাদের কপাল বড় হতে হতে মাথার মাঝে চলে গিয়েছে, অথবা যাদের কপাল ঢেকে গেছে বেয়াড়া চুলে, যাদের চোখ খুশিতে ছোট হয়ে হাসছে, অথবা পৃথিবীর সামনে যাদের চোখে শান্তি ও স্থিরতা সাজানো সব বাঙালি চোখ ও কপাল কথা বলছে।
তাদের দেখে ফেসবুক আমাকে পরামর্শ দিচ্ছে তুমি হয়তো এদেরকে চেনো। আমার মনে হয় সবাই পরিচিত। তবু চিনতে পারি না। অনেকেই হয়তো কোন এক রোদে একই গাছের ছায়া দেখেছিলাম। অন্তত একই মেঘের বিভিন্ন ছায়ায় ছিলাম আমরা।
একই শীতে ভিন্ন রঙের উলের জামা পরেছি আমরা, একই গান শুনেছি ভিন্ন কোন দিনে, একই রঙের ফুল ভিন্ন ভিন্ন তীব্রতায় দেখেছি।
প্রলাপ/
জুন ২৯, ২০২১

Thursday, June 24, 2021

ক্লান্ত ইউনিকর্ন



তোমার ঘ্রাণ পেতে ব্যাকুল হয়ে ছিলাম বহুকাল।

যারা বৃক্ষের মতন স্থির
অপেক্ষায় তাদের শেকড় গজায়,
হয়তো তাদের ভোতা খুড়ে লুকানো থাকে অদৃশ্য শেকড়…
বৃক্ষের তপস্যা আমার হৃদয়ে নেই।
আমি সময় ভাঙি অনন্ত সময়ের দিকে চেয়ে
যেখানে উড়ে যায় নক্ষত্র অথবা ধ্রুবনক্ষত্রের স্বর –
অসংখ্য চন্দ্রগ্রস্থ রাতে
নির্লীপ্ত জোৎস্নাগলা নিঃসঙ্গতায়
ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে
নক্ষত্রের পানে তাক করা আমার কপালে গজিয়েছে একটি শিং
প্রতিটি একান্ত আলো-আধারির ক্ষণে
আমার আর হাত থাকে না
বাতাস কিংবা জোৎস্না ছুঁয়ে দেখার
আমার চোখে বাতাস লাগে
নাকে চাঁদের ঘ্রাণ
ঠোট শুধু কাঁপতে থাকে
তোমার জড়তার মত
অপেক্ষা অসংখ্য সবুজ ঘাস শুকনো খড়ের গাদা
তুমি অথবা প্রেম এক লুকানো সুঁই
আমার শ্বাস প্রশ্বাসের সুতারা যেন জানে কোথায় খুঁজতে হবে হবে তোমায়
অতঃপর অপেক্ষার ঘাসের মাঠে খুঁজতে খুঁজতে
তোমার ছায়া
আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হই এবং দাঁড়িয়ে থাকি অলৌকিক অশ্বের মত
শুনেছি ইতিহাসের শৈশবে সিন্ধু নদীর পাড়ে
তোমার ঘর ছিল
ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলতে থাকা
গাঢ় অন্ধকারে
ফসলের সুখ পেরিয়ে
ডুমুর গাছের ছায়া
তোমাকে বসতে দিত
মায়ার হৃদয় পেতে
(হয়তো সেও অপেক্ষায় ছিল তোমার!)
শিকারী সমাজ যারা পোষে পালোয়ান
আমাকে বধ্য ভেবে ছুঁড়ে তীর হানে বর্শা পাতে ফাঁদ
তীক্ষ্ম ঈর্ষা, তীব্র ঘৃণা, গহন উপেক্ষায়
বধ করতে চায় তারা নিরন্তর;
তোমার প্রেম বা প্রেমাধিক প্রেম
আমায় ভুলিয়ে রাখে
প্রেমের ভিতর।
-
জুন ২৩, ২০২১
Image: Kitiara, 2018 / www.goodfon.com

Sunday, June 20, 2021

খড়ি মোল্লাদের মাসনা সুলাসা

ইদানিং কিছু ফাতরা টাইপের মোল্লার উদয় হয়েছে। এরা ইসলাম সম্পর্কে দুয়েক পাতা পড়লেও কাণ্ডজ্ঞানের দিক থেকে বেক্কল। এদের কাঠমোল্লাও বলা যাবে না, খড়ি মোল্লা বলা যেতে পারে বড় জোর। এরা মাসনা সুলাসার আলাপ করে বেড়ায়। এদের ইসলাম সম্পর্কে বুঝ কম, কাণ্ডজ্ঞানও খারাপ।

কোরআনের বিবাহ সংক্রান্ত আয়াতে ‘আমর’ বা আদেশসূচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হলেও তা আবশ্যক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। অধিকাংশ আলেম বিয়ে ফরজ হওয়ার বিষয়কে শর্ত সাপেক্ষ মনে করেন। বিয়ে ফরজ হওয়ার নিয়ম আর্থিক সক্ষমতা থাকার পর শারীরিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার উপর নির্ভরশীল। কারো শারীরিক চাহিদা আছে, কিন্তু পয়সা নাই – তার জন্য পরামর্শ হলো রোজা রাখা। (এখন রোজা না রেখে শারীরিক চাহিদা বাড়ায় এমন খাবার বর্জন করার মাধ্যমেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।) মজার বিষয় হচ্ছে – এই একই পরামর্শ বাংলাদেশে উতলা হয়ে যাওয়া কিছু ফাতরা মোসলমান পুরুষদের বেশি বেশি শোনা উচিত। তাদের যদি মনে হয় শরীর তাদের খুব উৎপাত করছে, তাদের উচিত রোজা রাখার মত মহতী ইবাদতে মশগুল থাকা। উত্তেজক খাবার না খাওয়া। সমাজে ফাতরামি ছড়ানোর দরকার নেই।

একাধিক বিয়ের বিষয়টি ব্যতিক্রমি নিয়ম। সাধারণ নিয়ম নয়। কেউ যদি বিয়ে করতে না চায়, তাও একটি ব্যতিক্রমি বিষয়।

এক স্ত্রী বিদ্যমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়/তৃতীয়/চতুর্থ বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনে বাধা নেই। পুরুষের জন্য বহুবিবাহ নিষিদ্ধ নয়। তবে বিবাহিত থাকা অবস্থায় আরো বিয়ে করতে চাইলে আইনগত পদ্ধতি ও শর্ত মানতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনগত পদ্ধতি ও শর্তগুলো শরীয়ার কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন এবং সুষম ব্যাখ্যা বলা চলে। কোরআনের সাবধান বাণী ‘আর যদি তোমরা ভয় পাও যে তোমরা ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারবে না’—র আইনি রূপ পাওয়া যায় এসব শর্ত ও পদ্ধতিতে।

শর্তগুলো কি?

১. সালিশের মাধ্যমে এমন বিয়ের অনুমতি পেতে হবে। কেউ যদি মনে করে বিবাহিত অবস্থায় তার আরো বিয়ে করা প্রয়োজন – এই সিদ্ধান্ত সে নিজে নিলে তার পক্ষপাতমূলক বা বায়াসড হওয়ার ঝুঁকি আছে। এছাড়া বর্তমান স্ত্রীর স্বার্থ জড়িত থাকায় তার প্রতিনিধিত্ব ছাড়া সিদ্ধান্ত ন্যায্য হতে পারে না। তাই সালিশ গঠিত হবে স্বামীর প্রতিনিধি, বর্তমান স্ত্রীর প্রতিনিধি নিয়ে। এই সালিশ যদি যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয় মনে করে তবে কারণ উল্লেখপূর্বক এবং যদি কোন পক্ষের কোন যৌক্তিক শর্ত থাকে সেই শর্ত সাপেক্ষে এমন বিয়ের অনুমতি দিতে পারে।

সালিশের সিদ্ধান্তে যদি কেউ সন্তুষ্ট না হয় তবে সে আদালতের কাছে যেতে পারে। এক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।

২. প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিদ্যমান স্ত্রী/স্ত্রীগণের অনুমতি। তাদের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবে না।

শর্ত লঙ্ঘন করলে তাকে দুটি পরিণতি ফেইস করতে হবে – প্রথমত, তৎক্ষণাৎ স্ত্রীর দেন মোহর সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, এক বছর কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় ধরনের শাস্তি পেতে হবে।


মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, ধারা ৬

বহুবিবাহ:

১) কোন ব্যক্তি বিবাহিত অবস্থায় সালিশী কাউন্সিলের লিখিত অনুমতি ছাড়া আর বিয়ে করতে পারবে না; বা এধরনের অনুমতি ছাড়া কোন বিয়ে ১৯৭৪ সনের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন এর অধীনে নিবন্ধিত হবে না।

২) ১নং উপধারা অনুযায়ী অনুমতির জন্য নির্ধারিত ফিস-সহ চেয়ারম্যানের কাছে দরখাস্ত করতে হবে; এবং তাতে প্রস্তাবিত বিয়ের কারণ এবং এ বিয়ের ব্যাপারে বর্তমান স্ত্রী অথবা স্ত্রীগণের সম্মতি নেয়া হয়েছে কিনা তা উল্লেখ থাকবে।

৩) ২নং উপধারা অনুযায়ী দরখাস্ত পাওয়ার পর চেয়ারম্যান দরখাস্তকাী ও বর্তমান স্ত্রী অথবা স্ত্রীগণের প্রত্যককে একজন করে প্রতিনিধি মনোনীত করতে বলবেন। (প্রতিনিধিদের নিয়ে) গঠিত সালিসী কাউন্সিল প্রস্তাবিত বিয়ে প্রয়োজনীয় ও ন্যায়সঙ্গত মনে করলে যৌক্তিক শর্ত থাকলে তা সাপেক্ষে দরখাস্ত মঞ্জুর করতে পারেন।

৪) দরখাস্তের বিষয় নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে সালিশী কাউন্সিল কারন উল্লেখ করবেন; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে কোন পক্ষ নির্দিষ্ট ফিস দিয়ে নির্দিষ্ট দফতরে সহকারী জজের নিকট রিভিশনের জন্য আবেদন করতে পারে; এ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বিবেচিত হবে এবং কোন আদালতে এ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

৫) কোন ব্যক্তি যদি সালিশী কাউন্সিলের অনুমতি ছাড়া অন্য বিয়ে করে তবে সে-

ক) বর্তমান স্ত্রী অথবা স্ত্রীগনের তলবী ও স্থগিত দেনমোহর সম্পূর্ণ তৎক্ষনাৎ পরিশোধ করবে। দেনমোহর পরিশোধ না করলে তা বকেয়া ভূমি রাজস্বরূপে আদায়যোগ্য হবে; এবং

খ) অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধী সাব্যস্ত হলে এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।


এই আইন ভাল না খারাপ সেই মোরালিস্ট আলোচনা এখানে করতে চাই না। তবে খড়ি মোল্লাদের যদি জিজ্ঞেস করেন, ইসলামে কি নারীদের দাসী হিসেবে রাখার বৈধতা আছে কিনা? তারা তখন আইসিসের মতন যৌনদাসী খুঁজতে কিতালের জন্য বেড়িয়ে পড়তে পারে।

Friday, March 12, 2021

টর্চার, শিক্ষা, ও সেক্যুলারিজম

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ (BLAST and ASK versus Bangladesh, Writ Petition No.5684/2010) ২০১১ সালের শুরুতে রায় দিয়েছিল। রায়ের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছে একই বছর।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি বাংলাদেশের অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বাদে সর্বত্র ছিল। রায়ের ১০ বছর পার হয়েছে। ১০ বছরে অগ্রগতি ভাল বলা যায়। আশা করা যায় ২০৩০ এর দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের টর্চারের মানসিকতা থাকবে না।
যদিও টর্চার যে নিষেধ এই কথা আমার স্টুডেন্টদেরকে বুঝাতে কষ্ট হয়েছে। বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে টর্চার বিদায় করার জন্য যে নৈতিক সাপোর্ট পরিবার এবং রাষ্ট্র থেকে আসবে – সেই পরিবার এবং রাষ্ট্র টর্চার জারি রাখলে তা হবে না। পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টর্চারমুক্ত করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের টর্চার বন্ধ করতে হবে। কারন যে মৌলিক অধিকার (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ এবং অন্যান্য) প্রয়োগের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি (টর্চার) নিষিদ্ধ সেই মৌলিক অধিকার রাষ্ট্র তার আইন শৃংখ্যলা বাহিনীর মাধ্যমে লঙ্ঘন করতে পারে না।
উল্লেখ্য, যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক মানসিক শাস্তি বন্ধ করা হয়, তখন ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল না। মাদরাসা (আলিম পর্যন্ত) এবং অন্যান্য সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ থাকলেও মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় ক্বওমী মাদরাসার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। যদিও ‘অন্যান্য সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ বলতে ক্বওমী মাদরাসাকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়; এবং সে হিসেবে ক্বওমী মাদরাসা উক্ত নীতিমালার বাইরে নয়।
২০১০ এর দশকে বাংলাদেশে তথ্যের গতি বেড়েছে ইন্টারনেটের কারনে। তাতে এই ধরনের টর্চারসহ আরো সব ডেভিয়েন্সের খবর আমরা জানতে পারছি। ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া সমাজের এবং রাষ্ট্রের ছবি দেখায়ে দিচ্ছে খুব সহজেই। ২০১১ সালের এই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বাড়লেও ক্বওমী মাদরাসায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের পরিমান বেড়েছে সম্ভবত অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরে। তথ্য প্রযুক্তির সাথে সমাজের এই পরিবর্তনের সংযোগ আছে। সমাজে যে ডিজিটাল ডিভাইড বিরাজমান তা আরো বড়সড় অর্থনৈতিক বৈষম্যের বাচ্চা। এই বৈষম্যের নানান রকম প্রকাশের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি।
এছাড়া বাঙালি মোসলমান এখনো বিদ্যা বিতরনে কৃপণ। বিশেষত আধুনিক শিক্ষিত কিংবা সেক্যুলার বাঙালি শিক্ষা বিস্তারে ততটা আগ্রহী বা সফল নয়। শিক্ষার ভার পীর সাহেব আর দুনিয়াদারির খোঁজ না রাখা মাওলানা-মৌলবিদের হাতে দিয়ে মানুষের সুন্দর দুনিয়াবি জীবন হবে না। আপনারা সেক্যুলারিজমকে শুধু মন্ত্র হিসেবে বিশ্বাস করলে অন্যের ইহকাল ভাল হবে না। অন্তত সকলের ইহকাল বা দুনিয়ার জীবনকে সহজ সুন্দর করে তোলার চেষ্টা না থাকলে আপনি বরং সেক্যুলারিজমকে এন্টিরিলিজিয়াস এক্সট্রিমিজিম থেকে মুক্ত করতে পারবেন না। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের এই স্ববিরোধী হয়ে উঠার দায় পুরাটা নন-সেক্যুলারদের নয়, সেক্যুলারিজমের সমর্থকদেরও।
গত কয়েকবছরে অনেকেই দরদী হয়ে উঠছেন। অন্তত ক্বওমী মাদরাসায় পড়ুয়া শিশুদের নিজেদের শিশু হিসেবে ভাবতে পারছেন অনেকে। আরো বেশি দরদী হয়ে উঠলে এই সমাজে ধর্মের সত্যিকার পর্যালোচনা সম্ভব হবে।
টর্চার, শিক্ষা, সেক্যুলারিজম। মার্চ ১১, ২০২১/ নরমাল, ইলিনয়

৭ই মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ রেটরিকে আগ্রহী যে কারো কাছে একটি অসাধারণ এবং সফল ভাষণ। রেটরিকের যে তাৎক্ষণিক প্রভাব একজন ওরেটর বা বক্তার আকাঙ্ক্ষিত থাকে এই ভাষণের মাধ্যমে তা অর্জিত হয়েছে।

কিন্তু ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু রেটরিক বা নান্দনিক এক ভাষণে সীমাবদ্ধ নয়। ভাষণের সৌন্দর্য বর্ণনা করে নির্মলেন্দু গুণ তার সেরা একটি কবিতা রচনা করেছেন, ভাষণের ব্যকরণ বিচার করে এর প্রশংসা লিখেছেন আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
এছাড়া এই ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় এর নাম উঠেছে। তবে এই ভাষণের সংরক্ষণে বাংলাদেশের দুর্বলতা লজ্জাজনক। ভাষণের একাধিক ভার্সন আছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। রাষ্ট্রের আইসিটি ডিভিশনের প্রচারিত রেকর্ড, ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশন্স এর প্রচারিত রেকর্ড, এবং সংবিধানে সংযুক্ত ভাষণের লিখিত রূপ – এ তিনটি রেকর্ডে সামঞ্জস্য নেই। তাছাড়া সম্পূর্ণ ভাষণটি কোথাও পাওয়া যায় না। ভাষণটি কত মিনিট লম্বা ছিল তা নিয়ে একাধিক মতামত আছে। রেকর্ড সংরক্ষণের দুর্বলতা তথা ইফিসিয়েন্সির ঘাটতি ছাড়াও বাঙালি কালচারে রেকর্ড সংরক্ষণে সততার ঘাটতিও প্রকট। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে খুবই অদক্ষ। (মুক্তিযুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদের কোন পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকা রেকর্ড সংরক্ষণে ব্যর্থতার বড় প্রমাণ। হিটলারের জার্মানির রেকর্ড সংরক্ষণের দক্ষতার কারনে হলোকাস্টের ভয়াবহতা জানা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে শিখেছে গুম। আর তথ্যগুম শিখেছে বৃটিশ শাসনের অফিসিয়াল সিক্রেসি আইন থেকে।) ৭ই মার্চের ভাষণটিকে কাঁটাছেড়া করা এবং তার পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড না রাখার ব্যর্থতা প্রথমত আওয়ামী লীগের। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাজগত ইতিহাসকে দেবতা ও দানবে বিভাজিত আকারে দেখায় প্রভাবিত – তাই ইতিহাস কাঁটাছেড়া করার মত নির্লজ্জ, হীন, অপমানজনক এক আচরণ এখানে টিকে আছে।
ভাষণের রেটরিক হিসেবে সাফল্য, সৌন্দর্য, স্বীকৃতি, এবং রেকর্ড সংক্রান্ত ব্যর্থতা ছাড়াও এর রাজনৈতিক মূল্য আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতিহীনতার যে কথা বাজারে আছে তা এই ভাষণের সামনে টিকে না। ২৬শে মার্চ যে স্বাধীনতার ঘোষণা কোন অভিনব বিষয় ছিল না তার নির্দেশনা এই ভাষণে পাওয়া যায়।
এই ভাষণ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সেই প্রশ্ন করা যায়। যেই শোষন এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান ছিল সেই শোষণ এবং বঞ্চনা কি শেষ হয়েছে?
নাগরিক অধিকার রক্ষার যেই শাসনকাঠামো বানানোর বাসনা এই ভাষণে ঘোষিত হয়েছিল তা কি হয়েছে?
আইন দর্শনের একটি প্রশ্ন আমরা আলাপ করতাম। নাগরিকের আইন অমান্য করার অধিকার আছে কিনা? থাকলে কখন? ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের ইতিহাসে civil disobedience এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। যখন কোন শাসক জনগণকে তাদের পছন্দমত সরকার গঠন করতে না দেয়, তাদের সাথে প্রতারণা করে, এবং নির্যাতন নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের অধিকার অস্বীকার করে – তখন জনগণের নৈতিক অধিকার থাকে সরকার এমনকি রাষ্ট্রকে অমান্য করার। ৭ই মার্চে এদেশের জনগণ সেই নৈতিক অধিকারের চর্চা করেছেন। এই অধিকারের আলাপ আইনের কাঠামোর মধ্যে আর মিলবে না। কেননা আইন ঠিক করার প্রশ্ন এখানে জড়িত।
Civil disobedience ছাড়াও এখানে কিছু সাংবিধানিক অধিকার চর্চার বিষয় ছিল। বাকস্বাধীনতা, সমাবেশ, এবং সগঠিত হওয়ার অধিকার। সিভিল ডিজঅভিডিয়েন্স বা মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিংয়ের নন ভায়োলেন্ট এবং নন কোঅপারেশন মুভমেন্ট - সেসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল উদাহরণ ৭ই মার্চ। এই চরম উপায়ের রাজ-নৈতিকতার প্রশ্নের বাইরে বাংলাদেশে বর্তমানে সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক অধিকারগুলো কেমন আছে?
বাকস্বাধীনতা বা ফ্রিডম অব স্পিচের জন্য মানুষের যে Freedom from fear বা ভয়মুক্তির দরকার হয় – রাষ্ট্র কি মানুষকে সেই অভয় সংগীত শোনাতে পারছে? সমাবেশের অধিকার চর্চা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বেআইনি অত্যাচার – পুলিশি হামলা – থেকে মানুষ কি নিরাপদ? বাংলাদেশ কি তার জনগণের সংগঠনের অধিকার চর্চার সুযোগ নিশ্চিত করতে পারছে?

যদি না পারে তবে ৭ই মার্চ নিয়ে তামাশা করার ধৃষ্টতা আপনারা দেখায়েন না।

৭ই মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে। মার্চ ৬, ২০২১। নরমাল, ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র।

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরষ্পরকে বিরোধী হিসেবে বয়ানের অন্তত দুইটা ধারা আছে। এই দুই ধারা একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। একদল মুক্তিযুদ্ধের দখল চায়...